মো: সাইফুল্লাহ খাঁন: সাংবাদিকতা—একটি পেশা নয়, বরং একটি দায়িত্ব, এক মহান ব্রত। সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার প্রতিনিধিত্ব করে যে কণ্ঠ, তাকে বলা হয় সাংবাদিকতার কণ্ঠ। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিটি বাঁকে সাংবাদিকতা রেখেছে অনন্য ভূমিকা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই পেশাটি এখন কঠিন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—যেখানে নীতি, ন্যায়ের সংগ্রাম চলছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক চাপ, তথ্যবিকৃতি এবং সীমিত মতপ্রকাশের পরিবেশের বিরুদ্ধে।
এই প্রবন্ধে আমরা সাংবাদিকতার উৎপত্তি, তার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর ভূমিকা এবং সমসাময়িক সংকট, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও উত্তরণের পথ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছি।
ইতিহাসের পাতা থেকে সাংবাদিকতার উত্থান:
সাংবাদিকতার গোড়াপত্তন ঘটে ইউরোপে, ১৬০৫ সালে জার্মানিতে প্রথম ছাপা সংবাদপত্র (Relation) প্রকাশের মাধ্যমে। এরপর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংবাদপত্র ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশে। উপমহাদেশে প্রথম সংবাদপত্র হিকি’স বেঙ্গল গেজেট (১৭৮০), যেটি ছিল বৃটিশ শাসনের সমালোচনায় এক সাহসী কণ্ঠ।
বাংলা ভাষায় সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু সমাচার দর্পণ (১৮১৮)-এর মাধ্যমে, যা সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে নজরুল—তারা শুধু কবি বা সমাজসংস্কারক ছিলেন না, ছিলেন প্রতিবাদী সাংবাদিকও।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ঐতিহ্য ও সংগ্রাম
ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান প্রভৃতি পত্রিকা হয়ে উঠেছিল মানুষের মুখপত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, প্রবাসী সাংবাদিকেরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতায় এসেছে নানাবিধ পরীক্ষা। গণতন্ত্র রক্ষায় সাংবাদিকরা বারবার নির্যাতিত হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন, এমনকি প্রাণ দিয়েছেন। শহীদুল জহির, গোলাম মাওলা রনি, হুমায়ুন কবীর বালু—তাদের জীবন ও মৃত্যু সাংবাদিকতার মূল্য কেমন তা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে।
মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন মতপ্রকাশ: গণতন্ত্রের বাতিঘর সাংবাদিকতার প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমে। একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্য যাচাইয়ের অন্যতম সূচক হলো তার সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
মুক্ত গণমাধ্যম মানে শুধু সেন্সরশিপমুক্ত সংবাদ নয়, বরং সংবাদকর্মীদের তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, এবং রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি চাপমুক্তভাবে কাজ করার পূর্ণ নিশ্চয়তা।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে গণমাধ্যম চাপ, হুমকি ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে। ফলে সত্য প্রকাশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে মালিকানাগত প্রভাব ও বিজ্ঞাপননির্ভরতা সাংবাদিকদের নিরপেক্ষতা হ্রাস করছে।
সমসাময়িক সংকট: কোথায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতা?
১. মতপ্রকাশ ও তথ্যপ্রবাহের সংকুচিত পরিসর
সাংবাদিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় নজরদারি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা বিধিনিষেধ গণমাধ্যমকে আত্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গণতন্ত্রের ভিত্তি।
২. অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও চাকরির নিরাপত্তাহীনতা
বহু সংবাদপত্র আর্থিক সংকটে বন্ধ হচ্ছে, ছাঁটাই হচ্ছে সাংবাদিকরা। যারা আছেন, তারাও সম্মানজনক বেতন পান না। পেশাটি তরুণদের কাছে নিরাপদ বা আকর্ষণীয় নয়।
৩. রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সংবাদ বিকৃতি
সাংবাদিকতা আজ অনেক ক্ষেত্রে দলীয় স্বার্থের হাতিয়ার। অনেক মিডিয়া রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এতে স্বাধীন সাংবাদিকতার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।
৪. তথ্যদূষণ ও গুজবের আধিপত্য
ডিজিটাল যুগে গুজব এবং অসত্য তথ্য ছড়ানোর হার বেড়েছে। মূলধারার গণমাধ্যম যাচাইকৃত সংবাদ প্রচার করলেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া খবরই অধিকাংশ মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলে।
৫. নৈতিকতার অবক্ষয় ও অবহেলিত পেশাগত মান
সাংবাদিকতা আজ পেশাগত মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ। দ্রুততম সংবাদ দেওয়ার চাপে অনেক সময় তথ্য যাচাই হয় না। আবার স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবেও কিছু সাংবাদিক নিরপেক্ষতা হারাচ্ছেন।
সমস্যা উত্তরণে করণীয়: একটি সম্ভাবনার রূপরেখা
১. সংবিধানসম্মত স্বাধীনতা নিশ্চিত ও আইনি সংস্কার
সাংবাদিকদের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা করতে হবে সংবিধান অনুযায়ী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী সকল আইন সংশোধন প্রয়োজন।
২. পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতা চর্চা
প্রতিটি সংবাদকর্মীর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিষয়ে কর্মশালা, ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যাবশ্যক।
৩. গণমাধ্যম নীতিমালা ও কমিশন গঠন
সরকার, সাংবাদিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে একটি স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠা করে সাংবাদিকদের সুরক্ষা, তদন্ত ও তদারকি নিশ্চিত করা উচিত।
৪. তথ্য যাচাই ও গুজব প্রতিরোধ ইউনিট
গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট-চেকিং ইউনিট বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে সমাজে তথ্যদূষণ কমানো যায়।
৫. ডিজিটাল সাংবাদিকতার নিয়মনীতি প্রণয়ন
অনলাইন পোর্টাল ও ইউটিউব-নির্ভর সংবাদ পরিবেশনকারীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন, আচরণবিধি ও নীতিমালা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সাংবাদিকতা ফিরে পাক নৈতিক আলোয় আলোকিত পথ
একটি জাতির বিবেক তার সাংবাদিক সমাজ। সেই বিবেক যেন চাপ, প্রলোভন ও ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে পারে, তা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। সাংবাদিকতা যেন শুধুই খবর পরিবেশন নয়, হয়ে উঠুক সত্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের একটি স্থায়ী আন্দোলন।
তথ্যযুদ্ধের এই সময়ে সাংবাদিকতার সংকট উত্তরণ করে মানবিকতা, সত্য এবং নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকতা আমাদের প্রত্যাশা।
যোগাযোগ :
বাসা নং-১৯, ৫ম তলা, রোড-৭/এ,
ব্লক-বি, বারিধারা, গুলশান, ঢাকা-১২১২
সম্পাদক ও প্রকাশক : নাজমা সুলতানা নীলা
মোবাইল: ০১৬২২৩৯৩৯৩৯
ইমেইল: nazmaneela@gmail.com