মো. সাইফুল্লাহ খান, (সাংবাদিক ও কলামিস্ট):
সমাজ পরিবর্তনের দাবি নতুন নয়
সমাজে পরিবর্তনের দাবি যেন চিরন্তন এক উচ্চারণে পরিণত হয়েছে। বাজারে, রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রেনে, চায়ের দোকানে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমরা শুনি—“এই সমাজটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে” অথবা “আগের সমাজ আর নেই!”এই হতাশার সুরের মাঝেই হারিয়ে যায় এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—এই সমাজটা কে বদলাবে?
সাম্প্রতিক সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তকদের মতে, সমাজ মানেই হলো মানুষের সম্মিলিত অস্তিত্ব। আমরা সবাই সমাজের অংশ। আমাদের চিন্তা, মনোভাব, আচরণ—সবকিছু মিলে তৈরি হয় সমাজ। কাজেই সমাজের দায় কেবল রাষ্ট্র, সরকার বা নেতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে দূরে সরে থাকলে চলবে না। আমরা যেমন, আমাদের সমাজও তেমন। তাই সমাজ বদলাতে হলে আগে বদলাতে হবে আমাদের—আমি ও তুমি।
আমরা সবাই সমাজের প্রতিচ্ছবি
আজকের সমাজে যা কিছু সমস্যা বলে চিহ্নিত—দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, অবিচার, বৈষম্য, মাদক, নৈতিক অবক্ষয়—সবকিছুর দায় আমরা প্রায়শই রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর চাপিয়ে দিই। অথচ আমরা নিজেরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, সেই আত্মজিজ্ঞাসা করি না। আমরাই কি আমাদের নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি? আমরাই কি রাস্তায় আইন মানি? আমরাই কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াই?
সমাজ নিয়ে অভিযোগ তোলার আগে দরকার আত্মবিশ্লেষণ। নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে—“আমি কি একজন ভালো মানুষ? আমি কি আমার আশপাশে ইতিবাচক প্রভাব রাখছি?” যদি নিজের মধ্যে সততা ও নৈতিকতা অনুপস্থিত থাকে, তাহলে সমাজ বদলের স্বপ্ন কেবল কথার ফানুস হয়েই থেকে যাবে।
পরিবর্তনের শুরু হোক নিজের ভিতর থেকে
বিপ্লব সবসময় রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে বা স্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সত্যিকারের বিপ্লব ঘটে চিন্তায়, মননে ও আচরণে। একজন সৎ দোকানি, একজন দায়িত্ববান শিক্ষার্থী, একজন সচেতন নাগরিক—তাদের ছোট ছোট সৎ কাজগুলো দিয়েই গড়ে উঠতে পারে একটি সুবিচারভিত্তিক সমাজ।
একজন ট্রাফিক পুলিশ যদি নিয়ম রক্ষা করেন,
একজন ব্যবসায়ী যদি কর ফাঁকি না দেন,
একজন অভিভাবক যদি সন্তানকে সত্যের শিক্ষা দেন, তাহলেই ধীরে ধীরে সমাজে আসবে ইতিবাচক পরিবর্তন। একটি পরিবারই হতে পারে সমাজ সংস্কারের প্রথম ভিত্তি—যেখানে চর্চা হবে ন্যায়, শিক্ষা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধের।
তরুণরাই সমাজ পরিবর্তনের চালিকাশক্তি
বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ। এই বিশাল অংশই ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সম্ভাব্য বাহক। কিন্তু শুধু ভবিষ্যতের কথা ভাবলে হবে না—আজ থেকেই তাদের নিতে হবে দায়িত্ব।
তরুণরা অনলাইন-অফলাইন, উভয় মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গুজব ও অপপ্রচার বন্ধ করে সত্য তথ্য প্রচারে উদ্যোগী হলে সমাজে সচেতনতা বাড়বে।
একজন কলেজছাত্র যখন সড়ক আইন মেনে চলে, একজন তরুণী যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে,
একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর যখন ইতিবাচক বার্তা ছড়ায়— তখনই সমাজ পরিবর্তনের বাস্তব সূচনা ঘটে।
তরুণ প্রজন্মের চিন্তা, কণ্ঠ ও কর্মই বদলে দিতে পারে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা ও দায়িত্বশীল মানসিকতা।
শুধু আইন নয়, বদলাতে হবে মানসিকতা
বিভিন্ন আইন, নীতিমালা ও প্রশাসনিক কাঠামো যতই শক্তিশালী হোক না কেন, যদি মানুষের মানসিকতা পরিবর্তিত না হয়—তবে সেই আইন কার্যকর হবে না।
যদি একজন নাগরিক মনে করেন, “আমি ঠিক থাকলে হলো, অন্যরা কী করছে সেটা আমার বিষয় নয়,” তাহলে সমাজের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়।কারণ, সমাজ মানে শুধুই ‘অন্যেরা’ নয়—সমাজ মানে আমি ও তুমি। তাই, সমাজ বদলানোর জন্য চাই মানসিকতার বিপ্লব। নিজেকে বদলানোই হবে বৃহত্তর পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ।
দায়িত্ববোধই হতে পারে সমাজ গঠনের হাতিয়ার
সমাজ পরিবর্তনের জন্য কেবল প্রতিবাদ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেই চলবে না। দরকার দৈনন্দিন জীবনে দায়িত্বশীল আচরণ।
একজন মা যদি ছেলেমেয়েকে সমান ভালোবাসেন, একজন শিক্ষক যদি নকলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন,একজন সাংবাদিক যদি নিরপেক্ষ থাকেন—
তাহলেই ধীরে ধীরে সুদৃঢ় হবে সমাজের ভিত্তি।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, সততা, সহনুভূতি ও দায়িত্ববোধ। আমরা যদি নিজেরা এসব গুণ ধারণ করি, তাহলে সমাজ নিজে থেকেই বদলে যাবে।
পরিবর্তনের সূচনা হোক এখান থেকেই, আজ থেকেই
সমাজ পরিবর্তন কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটি সময়সাপেক্ষ, তবে সম্ভব।
প্রত্যেক মানুষ যদি তার অবস্থান থেকে ন্যূনতম দায়িত্ব পালন করে, তাহলে একদিন একটি সুন্দর, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে।
সুতরাং, সমাজের দিকে আঙুল তোলার আগে দরকার আয়নার সামনে দাঁড়ানো। আমি যদি বদলাই, তুমি যদি বদলাও—তবে একদিন সত্যিই বদলে যাবে আমাদের সমাজ।
যোগাযোগ :
বাসা নং-১৯, ৫ম তলা, রোড-৭/এ,
ব্লক-বি, বারিধারা, গুলশান, ঢাকা-১২১২
সম্পাদক ও প্রকাশক : নাজমা সুলতানা নীলা
মোবাইল: ০১৬২২৩৯৩৯৩৯
ইমেইল: nazmaneela@gmail.com