মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ: দীর্ঘদিন ধরেই এক ভয়ানক বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে—মাধ্যমিক শিক্ষার মানহীনতা। এটি এখন কেবল আলোচ্য নয়, বরং জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য যেখানে হওয়া উচিত ছিল জ্ঞানার্জন, চরিত্র গঠন ও মূল্যবোধের বিকাশ, সেখানে আজ শিক্ষার্থীরা পরিণত হচ্ছে নম্বর তোলার যন্ত্রে। এই শিক্ষার কাঠামো এখন মানুষ নয়, সার্টিফিকেট উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে।
শিক্ষার কাঠামো নাকি পরীক্ষার কারখানা?
আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা আজ এক ভয়াবহ পরীক্ষানির্ভর ব্যবস্থায় আটকে আছে। ক্লাসে শেখার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর তোলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শিক্ষকরা এখন প্রশ্ন ধরেই পড়ান, শিক্ষার্থীরাও প্রশ্ন মুখস্থ করেই উত্তীর্ণ হওয়ার চিন্তায় ব্যস্ত। তাদের শেখা বিষয়গুলোর অর্ধেকও তারা বুঝে না, শুধুই মনে রাখে যতক্ষণ না পরীক্ষার দিন আসে। এরপর সব ভুলে যায়। এই প্রক্রিয়ায় আমরা চিন্তাশীল মানুষ নয়, যান্ত্রিক ছাত্র তৈরি করছি।
মূল্যবোধের সংকট ও শিক্ষার উদ্দেশ্যহীনতা
শিক্ষা কেবল পাসের জন্য নয়; এটি মানুষ গঠনের প্রক্রিয়া। কিন্তু আজকের শিক্ষা সেই মানবিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে। দেশপ্রেম, সততা, সহানুভূতি, সামাজিক দায়িত্ববোধ—এই শব্দগুলো এখন পাঠ্যবইয়ের অলংকারমাত্র। বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। শিক্ষার উদ্দেশ্য যখন চরিত্র নয়, বরং চাকরি হয়ে দাঁড়ায়, তখন সমাজে নৈতিকতা ও মানবিকতার অবক্ষয় অনিবার্য হয়ে পড়ে।
শিক্ষার্থীদের রাজনীতিকরণ ও বিদ্যালয়ের অপব্যবহার
আজকের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতির আহ্বানে বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে এক শ্রেণির রাজনৈতিক বড়ভাই তাদের নানা লোভ দেখিয়ে দলে টানতে চায়—বিনামূল্যে বই, সুযোগ-সুবিধা, এমনকি ভবিষ্যতে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখানো হয়। কচি মন বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে পা বাড়ায়। ফলাফল, শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই জীবনের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যায়।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—বিদ্যালয়গুলো এখন রাজনৈতিক কর্মসূচির মাঠে পরিণত হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত করা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, এমনকি বিদ্যালয়ের মাঠে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আয়োজন—এসব কারণে শিক্ষার পরিবেশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষকরা নিরপেক্ষতা হারাচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নয়, রাজনীতিকে পেশা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।
শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হ্রাস
এই রাজনৈতিক প্রভাব, মুখস্থনির্ভর শিক্ষা এবং কোচিং নির্ভরতার কারণে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনেকেই নিয়মিত স্কুলে না গিয়ে কোচিং সেন্টারে সময় দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার শিক্ষার প্রতি অনীহা বোধ করছে, কারণ তারা ক্লাসে নতুন কিছু শিখছে না—শুধু পুরোনো বিষয় পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তরিক সম্পর্ক ও শিক্ষার আনন্দ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় শ্রেণীকক্ষ এখন অনেকটাই ফাঁকা। এটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক ভয়াবহ সতর্কসংকেত।
শিক্ষক কোথায়, শিক্ষা কোথায়?
একসময় শিক্ষক ছিলেন জাতির বিবেক। এখন অনেকে পেশাকে নয়, চাকরিকে গুরুত্ব দেন। বিদ্যালয়ে সময় কম, কোচিংয়ে সময় বেশি। ফলে স্কুল পরিণত হয়েছে “সনদ সংগ্রহের স্থান”-এ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তরিক সম্পর্ক বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক যদি অনুপ্রেরণার উৎস না হন, তাহলে শিক্ষা কখনো জীবন্ত হয় না। শিক্ষককে পুনরায় মর্যাদার আসনে ফিরিয়ে আনতে হলে তাঁদের প্রশিক্ষণ, সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
অভিভাবকের চাপ ও শিক্ষার্থীর মানসিক সংকট
আজকের শিক্ষার্থী এক অদৃশ্য মানসিক চাপে দিন কাটাচ্ছে। অভিভাবক চান সন্তান যেন “প্রথম” হয়, সমাজ তুলনা করে কে কার ছেলে কত ভালো। কিন্তু কেউ ভাবে না, প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন ভিন্ন। ফলে “ভালো ছাত্র” ও “খারাপ ছাত্র” নামের বিভাজন তৈরি হয়, যা তাদের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়। অনেক শিক্ষার্থী বিষণ্ণতা ও আত্মহীনতায় ভোগে। মানসিক স্বাস্থ্যকে এখন শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ করতেই হবে।
মানহীন বই ও বিভ্রান্ত শিক্ষাক্রম
নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, কিন্তু শিক্ষকরা তার জন্য প্রস্তুত নয়, স্কুলে উপযুক্ত পরিবেশও নেই। ফলে বইয়ের ভাষা, উদাহরণ, বিষয়বস্তু—সবই অনেকের কাছে অস্পষ্ট ও জটিল মনে হচ্ছে। শিক্ষকও বুঝে না, ছাত্রও নয়। ফলাফল, শিক্ষার মান আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। শিক্ষাক্রমের সংস্কার যদি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বাস্তব জীবনের প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে না মেলে, তবে এটি কেবল কাগজে রয়ে যাবে।
ভবিষ্যতের চিন্তা: আমরা কোথায় যাচ্ছি?
প্রশ্ন একটাই—আমরা আসলে কী শেখাচ্ছি? আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য কি কেবল চাকরি পাওয়া, না কি একজন দায়িত্বশীল নাগরিক গঠন? আজকের শিক্ষার্থী যদি বাস্তবজ্ঞান, নৈতিকতা ও সৃজনশীলতা না শেখে, তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ অন্ধকারেই থেকে যাবে।
করণীয়ঃ
১️। শিক্ষক প্রশিক্ষণকে বাস্তবমুখী ও গবেষণাভিত্তিক করতে হবে।
২️। পাঠ্যবইয়ের ভাষা ও বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর মানসিক স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
৩️। পরীক্ষানির্ভরতার পরিবর্তে শেখার আনন্দ ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রবর্তন করতে হবে।
৪️। অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে—শিক্ষা মানে শুধু নম্বর নয়, মানবিকতা।
৫️। রাজনীতি থেকে শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে। বিদ্যালয়ে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা দলীয় প্রভাব চলবে না—এটি নিশ্চিত করতে হবে।
৬️। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীর নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিদ্যালয়ে আকর্ষণীয় শেখার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
শেষ কথাঃ
শিক্ষা যদি মানুষকে আলোকিত না করে, তবে সে শিক্ষা অন্ধকারই ছড়ায়। আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষায় এখন সংস্কার নয়, প্রয়োজন বিপ্লব—ভাবনায়, প্রয়োগে, মানসিকতায়। শিক্ষা হতে হবে জীবনঘনিষ্ঠ, মানবিক ও নৈতিক। সেই দিনই আমরা বলতে পারব—বাংলাদেশে শিক্ষা মানে কেবল চাকরির প্রস্তুতি নয়, বরং মানুষ গড়ার এক মহান যাত্রা।
লেখক--
শিক্ষক ও সাংবাদিক
সাধারণ সম্পাদক
মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাব
পিরোজপুর।
sharifsstyle@gmail.com
যোগাযোগ :
বাসা নং-১৯, ৫ম তলা, রোড-৭/এ,
ব্লক-বি, বারিধারা, গুলশান, ঢাকা-১২১২
সম্পাদক ও প্রকাশক : নাজমা সুলতানা নীলা
মোবাইল: ০১৬২২৩৯৩৯৩৯
ইমেইল: nazmaneela@gmail.com