• আজ ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইমামতির আড়ালে এমএলএম ব্যবসা, হাতিয়ে নিলো ১৭ হাজার কোটি টাকা

| নিউজ রুম এডিটর ৮:২৭ অপরাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ১০, ২০২১ রাজধানী

মসজিদের ইমাম হওয়ার সুবাদে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিলো রাগীব আহসানের (৪১)। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চালু করেন এমএলএম ব্যবসা। একদিকে অল্প টাকা বিনিয়োগ করলে বেশি টাকা মুনাফা দেওয়া হবে এমন প্রলোভন, অন্যদিকে মসজিদের ইমাম হওয়ায় তাঁর এমন প্রতিশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন। এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রাগীব হাসান চক্র হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে অভিযান চালিয়ে সহোদর মো. আবুল বাশার খান (৩৭) সহ রাগীব আহসানকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি এমএলএম কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও গ্রেফতারকৃতদের প্রতারণার ঘটনা প্রচারে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য ও আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। এর ফলশ্রুতিতে র‌্যাব ছায়াতদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

তিনি বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর রাতে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ এর একটি দল রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাগীব আহসান (৪১) ও তার সহযোগী আবুল বাশার খান (৩৭) কে গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন।

র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান জানান, তিনি ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশুনা শুরু করেন। পরে ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে মুফতি সম্পন্ন করেন। অতঃপর তিনি পিরোজপুরে একটি মাদ্রাসায় চাকরি শুরু করেন।

র‌্যাবকে রাগীব আহসান আরও জানান, ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে তিনি ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। মূলত এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে এমএলএম কোম্পানির আদ্যপান্ত রপ্ত করেন তিনি। পরবর্তীতে নিজে ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

র‌্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীব মূলত ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে অপব্যবহার করে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করে। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, ইমাম শ্রেণি ও অন্যান্যদের টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। ‘শরিয়ত সম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’ এর বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন তিনি। এছাড়াও তিনি ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের নামে ব্যবসায়িক প্রচার প্রচারণা করতেন। লাখ টাকার বিনিয়োগে মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখান। ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করতে সমর্থ হন। এখন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতারকৃতের প্রায় তিনশো কর্মচারী রয়েছে। যাদেরকে কোনো বেতন দেওয়া হয় না। কর্মচারীররা মাঠ পর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী গ্রাহক সংগ্রহ করেন। তাদেরকে গ্রাহকের বিনিয়োগের ২০% অর্থপ্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে তিনি দ্রুত গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্ষম হন। তবে তিনি এখন কর্মচারী, গ্রাহক সকলকেই প্রতারিত করেছেন।

গ্রেফতারকৃত রাগীব আহসান জানান, তিনি ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোঃ (১) এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, (২) এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, (৩) এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, (৪) নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, (৫) জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, (৬) হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), (৭) আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, (৮) পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, (৯) এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, (১০) মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, (১১) মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, (১২) এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, (১৩) এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, (১৪) ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, (১৫) এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, (১৬) এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার, (১৭) এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।

র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, ভুক্তভোগীরা দাবী করেন, এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা জমি করেছেন। এসব বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

র‌্যাব জানায়, রাগীব আহসান তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। তার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে শ্বশুর প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি, পিতা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এছাড়া রাগীব আহসানের ৩ ভাইয়ের মধ্যে গ্রেফতারকৃত আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক, বাকি দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য। এভাবে তিনি ব্যাপক অনিয়ম করেছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।

র‍্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেফতারকৃত রাগীব আহসান জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তিনি হাউসিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, ব্যবসায়িক দোকান, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান এখন পর্যন্ত ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানান র‍্যাবের মুখপাত্র।

পিএন/জেটএস