উজ্জ্বল রায়, নড়াইল থেকে: নড়াইল জেলায় এক সময় পাট’ পুজা খুবই জাঁক-জমক সহকারে করা হয়। চড়ক পূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘পাট পুজা। শিবের প্রতিকৃতির নাম ‘পাট’। কাঠের পাটের মধ্যে থাকে শিবলিঙ্গ। রাতে গুরু সন্যাসী সেটি নদীতে নিয়ে যান।
এ সময় আয়োজকরা সং সেজে অর্থাৎ ভুত- প্রেত- দৈত্য-দানবের মুখোশ পড়ে সন্যাসীকে বাধা দেয়। সন্যাসী তান্ত্রিক ক্ষতায় সব বাধা উপেক্ষা করে পাট চালান করিয়ে তেল-সিঁদুর-চন্দন মেখে দেন। রাতে পাটকে স্নানের পর অজস্র পুজারীদের সামনে পাটকে মাঝখানে রাখা হয় তার পরে নাচ গানের মধ্য দিয়ে বালারা ধুপ পোড়ায় ও পাটকে লাল গামছা দিয়ে মুড়িয়ে নেয়। এসময় সমস্বরে‘ জয় বাবা শিব শংকরো, এইবার উদ্ধার করো’ বলে ধ্বণি দেয়া হয়। সংগে সঙ্গে একখানা সজ্জিত কাঠ দেবতা হয়ে ওঠে।
তাতে গামছা প্যাঁচিয়ে দেয়া হয়। সিঁদুরে মাখানো হয় মাথার দিকটা। তারপর একজন সুঠাম দেহী পাট চালানে নেয় এবং ঘোরাতে ঘোরাতে মাথায় তুলে দেয় ছুট। মন্দিরের কাছে গিয়ে সে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে যায়। তাকে সুস্থ করা হয় মাথায় জল দিয়ে। তারপর দিন থেকে বাড়ি বাড়ি ঘোরা হয় পাট নিয়ে। খর রোদে পাটের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত—হয় অজস্র কিশোর কিশোরী। চৈত্রের রোদ পোড়া একদল নারী পুরুষ। দলে থাকে একজন শিব ও একজন পার্বতী ও দু’জন সখী।
সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের দলও বলা হয় আবার অষ্টকের দলও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা। সাথে বাজে ঢাক ,কাসি-বাঁশি আরো কতোকি। এই পাট একজন মাথায় নেয় আর বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এই পাটের সামনে কোন গর্ভবতী মহিলা পড়লে তার বিপদের আশঙ্কা থাকে বলে মনে করা হয়। এসব পূজার মূলে রয়েছে ভুতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজেও পালন করা হতো।
যে কারনে দেখা যায় পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। এর মধ্যে জিভে বান ও পিঠে বড়শী ফোড়া খুবই অমানবিক দৃশ্যের অবতারনা করলেও এখানে যারা আসে তারা স্বেচ্ছায়ই আসে। গিরি সন্ন্যাসের দিনে সন্ন্যাসী বা বালারা ভিন্ন তালে নেচে নেচে গায়- আমরা শিবের নামে আছি/ শিবের নামে বাঁচি। গোঁসাই শিবের নামে
আছি/ বাঁচি রে–পাট বাড়ি বাড়ি গেলে খেজুর ভাঙা উৎসব হয়। একজন বালা খেজুর গাছ ধরে খেজুরের কাটা উপেক্ষা করে একদম, গাছের মাথা উঠে যায়খেজুর ছুঁড়ে দেয় সবার দিকে। ওই খেজুর ঘরের দুয়ারে বেধে রাখা হয় আপদ বিপদ তাতে দূরে থাকে বলে মানুষের বিশ্বাস।
এর পর পাট সামনে রেখে বালারা নানা রকম খেলা দেখান শারিরীক কসরত করে এটাকে অনেক অঞ্চলে পাট নাচানি’ বলে।