• আজ ১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
 গালির স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করেছিলাম: হাসনাত | প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব | টাকা ছাপিয়ে আবারও ২৫শ কোটি টাকা ঋণ দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক | মাগুরার নোমানী ময়দানে সেই শিশুর জানাজা অনুষ্ঠিত | মাগুরার সেই শিশু ধর্ষণে জড়িতদের দ্রুত বিচারের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার | মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে হার মানলেন মাগুরার সেই আছিয়া | এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রি ছাড়া কেউ ডাক্তার লিখতে পারবে না | শাহবাগীদের সতর্ক করে হাসনাত আবদুল্লাহ’র পোস্ট | হাবিবুল্লাহ বাহারের  উপাধ্যক্ষকে কুপিয়ে হত্যা, ফরিদপুর থেকে দম্পতি গ্রেফতার  | গণজাগরণের লাকির গ্রেপ্তারের দাবিতে মধ্যরাতে উত্তাল ঢাবি |

২৩ বছরে হারালেন মা-বাবা-সংসার, রেখার আশ্রয় বোনের বাড়িতে

| নিউজ রুম এডিটর ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ | এপ্রিল ১৮, ২০২৪ আইন ও আদালত
আজিজুল ইসলাম বারী,লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ ধর্ষণে জড়িত দুই আসামিকে সহযোগিতা করার অপরাধে দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগের পর লালমনিরহাট কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ছোট বোনের বাড়িতে আশ্রিত হলেন রেখা খাতুন (৪৪)।
মুক্তি পেয়ে রেখা খাতুন জানান, পরিবারের সবাই মারা গেছেন। তার স্বামী বিয়ে করে অন্য আরেকজনের সাথে সংসার করছেন। এমনকি কারাগারের বন্দি জীবনে মা, বাবা, দুই বোন আর এক ভাইসহ আমার ২৫ জন আত্মীয় মারা গেছেন। এখন কোথায় যাবেন তার কাছে নেই কোন ঠিকানা।
রেখা খাতুনের বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কলাখাওয়া ঘাট এলাকায়।
জানা গেছে, ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর শিশু ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার হন রেখা খাতুন (৪৪)। একই মামলায় দুই আসামি চার-পাঁচ বছর জেল খেটে উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করলেও কারাগার থেকে বের হতে পারেননি রেখা খাতুন। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছর কারাগার থাকতে হয়েছিল তাকে।
ওই ঘটনায় ২০০৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রেখা খাতুনসহ তিন আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দণ্ডিত হন। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। তবে রেখা খাতুন দাবি, ‘শিশু ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না তিনি। অথচ ধর্ষণে সহায়তার করার অপরাধে কারাগারেই কেটে গেছে ২৩টি বছর।
গত মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ২৩ বছর জেল থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানতে পারেন তার পরিবারে আর কেউ নেই। এখন কোথায় তার ঠিকানা কিছুই জানে না।
জানাগেছে, রেখার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর শেষ হয়। এরপরও জরিমানার এক লাখ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাঁকে আরও তিন বছর কারাগারে আটক থাকতে হতো। সেই হিসাবে তাঁকে ২০২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত লালমনিরহাট জেলা কারাগারে থাকতে হতো। বিষয়টি জানতে পেরে রেখা খাতুনের মুক্তির জন্য সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসেন লালমনিরহাট-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মতিয়ার রহমান, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ ও লালমনিরহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম স্বপন। তাঁরা সম্মিলিতভাবে জরিমানার টাকা ৮ এপ্রিল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করে দেন। এর ফলে ঈদের দুই দিন আগে ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে তত দিনে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বাইরে অতিরিক্ত আরও চার মাস ছয় দিন কারাভোগ করেছেন।
কারাগারে যাওয়ার আগের ও পরের জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রেখা খাতুন বলেন, আমি জেলে থাকার সময় আমার মা, বাবা, দুই বোন আর এক ভাইসহ আমার ২৫ আত্মীয় মারা গেছেন। এ সময় তিনি আরও বলেন, আমি জেলে গেলে আমার স্বামী কোরবান আলী দ্বিতীয় বিয়ে করে এখন কোথায় আছেন তা কেউ বলতে পারে না। আমার বাবার বাড়িটা ধরলা নদীতে বিলিন হয়েছে। স্বামীর অবর্তমানে বাবার বাড়িতে জীবনের বাকি দিনগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার স্বপ্নটাও ভেঙে গেছে। আমি এখন কোথায় যাব?।
রেখা খাতুনের বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কলাখাওয়া ঘাট এলাকায়। ধরলা নদীতে কলাখাওয়া ঘাটের বাবার বাড়ির ভিটা বিলীন হয়ে গেছে। ১৫ বছর আগে রেখার বাবা ফজলু রহমান মারা যান। আর মা নূরনাহার বেগম মারা যান ১২ বছর আগে। তাঁদের কবরও গ্রামের বাড়িতে হয়নি। পাশের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের কবির মামুদ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। ওই গ্রামে রেখার ছোট বোন টুম্পা বেগমের বিয়ে হয়েছে। কারামুক্তির পর টুম্পার শ্বশুরবাড়িতেই রেখা আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দারিদ্র্যের কারণে ১৩-১৪ বছর বয়সে রেখা খাতুনের বিয়ে হয়। তাঁর স্বামী কোরবান আলী তখন ৩৪ বছরের যুবক। পেশায় দিনমজুর ছিলেন কোরবান। বিয়ের পরও দুই-তিন বছর বাবার বাড়িতে থেকে ১৯৯৮ সাল থেকে স্বামীর বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। রেখা ও তাঁর স্বামী কোরবান আলী লালমনিরহাট শহরের খোচাবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি লালমনিরহাট শহরের নর্থ বেঙ্গল মোড় এলাকার দুলাল হোসেনের ছেলে আলমগীর হোসেন ও লালমনিরহাট শহরের কুড়াটারি গ্রামের ভোলা মিয়ার ছেলে ফরিদ হোসেন। রায় ঘোষণার সময় ফরিদ হোসেন পলাতক ছিলেন। পরে গ্রেপ্তার হন। ওই দুই আসামি চার-পাঁচ বছর জেল খেটে উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। এর মধ্যে আলমগীর হোসেন দাম্পত্য কলহের জের ধরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ফরিদ হোসেন লালমনিরহাট শহরের একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। অথচ তাদের সহায়তার অপরাধে দন্ডিত রেখা খাতুন কারাভোগ করলেন দীর্ঘ ২৩ বছর।
নারী অধিকার সংগঠক ফেরদৌসী বেগম বলেন, রেখা খাতুন এর সঙ্গে কথা বলে তার জীবনের গল্প আমরা শুনেছি। সেই হিসেবেই লালমনিরহাট ৩ আসনের সংসদ  সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলে তার মুক্তির বিষয়ে ব্যবস্থা করেছি।
রেখার জরিমানার টাকার অঙ্ক ১ লাখ টাকা হলেও তিনি অতিরিক্ত চার মাস ছয় দিন কারাগারে সাজা ভোগ করায় জরিমানা থেকে ১০ হাজার টাকা মওকুফ হয়ে যায়। এর বাইরে রেখা কারাগারে অবস্থানকালের শ্রমের বিপরীতে উপার্জন করেন ১৫ হাজার টাকা। ওই টাকা সমন্বয় হয়ে পরিশোধ করতে হতো ৭৫ হাজার টাকা। সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও পৌরসভার মেয়র সম্মিলিতভাবে ওই টাকা দিয়েছেন। ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট জেল সুপার ওমর ফারুক বলেন, কারাগারে রেখা খাতুনকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি হস্তশিল্পের কাজ করে উপার্জন করতে পারবেন। রেখা ২৩ বছর ৪ মাস ৫ দিন লালমনিরহাট জেলে কাটিয়েছেন। ওই নারী অত্যন্ত ভালো মানুষ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অর্জন করেছেন। তাকে সহায়তা করলে হস্তশিল্পের কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।