

দুঃসংবাদ নিভতে বসেছে ৫৩ কোটি ১০ লক্ষ টাকা লুটপাটের পানি প্রকল্প!
মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি
পিরোজপুর: জন্মিলে পানি মরিলেও পানি।পানির মহা দূর্নীতিতে নিভতে বসেছে ৫৩ কোটি ১০ লক্ষ টাকার পানি প্রকল্প,বিপাকে অর্ধ লক্ষাধিক পৌরবাসী!সংষ্কারে দরকার ১৮ কোটি টাকা।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া পৌরসভায় বাংলাদেশ সরকার ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং স্হানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় উপকূলীয় শহর পরিবেশগত অবকাঠামো প্রকল্প’র (CTEIP)বিগত ২০১৬-২০১৭ ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫৩,০৯,৯৫,০৮৬.৬৫/- ( তিপ্পান্ন কোটি নয় লক্ষ পচানব্বই হাজার ছিয়াশি টাকা পয়ষট্টি পয়সা) টাকা ব্যয়ে পৌরসভার অনতিদূরে টিকিকাটা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সূর্য্যমনি গ্রামে ১০ একর কৃষি জমি অধিগ্রহণ ও সুপেয় পানির প্রকল্প স্হাপন করে পৌর শহরে প্রায় ৬ কিঃমিঃ নেটওয়ার্ক পাইপের মাধ্যমে সংযোগ দেয়া হয়। সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্যে পাম্পহাউজ,গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার,৩ টি বড় পুকুর,প্রতিদিন ৪৫ লক্ষ লিটার পানি উৎপাদনে সক্ষম সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট,৩৫০০ সার্ভিস কানেকসন, ১০০ এইচপি পাওয়ারের দুটি জেনারেটর, ৫ লক্ষ লিটার ধারন ক্ষমতার দু’টি সুউচ্চ জলাধার,এম এস পাইপ দিয়ে প্রায় ৬ কিঃ মিঃ পাইপ লাইন নেটওয়ার্ক,ছোট বড় ৫ টি যান্ত্রিকভবন সহ প্রকল্পের যাবতীয় (প্যাকেজ নং CTEIP/2016-17/MAT/WS-01) কাজ গোপালগঞ্জ জেলার গোরস্হান রোডের ২৬৯ মিয়াপাড়াস্হ Sinoconst– M.T & S.S Consortium ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে প্লান্ট তৈরীর কাজ শুরু করে ১৫/১২/২০২০ তারিখ পরীক্ষা মূলক পানির লাইন চালু করা হয় এবং ০১/০৪/২০২১ ইং তারিখ হতে গ্রাহকদের পানি সরবরাহ ব্যবস্হায় দুই বছর যেতে না যেতেই এম এস পাইপে লিকেজ সমস্যার কারনে প্রতিদিন সংষ্কার করতে হয় যা ব্যয়বহুল।সে কারনে প্রতিদিন ৫ লক্ষাধিক লিটার পানি অপচয় হয়।বর্তমানে পানি সরবরাহে আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও নিয়মিত পানি সরবরাহ করতে না পারায় হিমসিম খাচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ।ভূগছে পৌরবাসী।
৬ কিঃ মিঃ এম এস পাইপ এর সংষ্কার কাজ চলতে থাকলে পৌরবাসীকে নিয়মিত পানি সরবরাহ করা খুবই সমস্যা উল্লেখ করে এম এস পাইপের স্হলে এইচ ডি পি ই (HDPE: High density polythyline)পাইপ প্রতিস্হাপনের প্রস্তাব করে ২০২৪ সালে ভিন্ন স্মারকে তিনবার স্হানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয় এবং প্রধান প্রকৌশলী স্হানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বরাবর লিখিত প্রস্তাব করেন পৌর কর্তৃপক্ষ।যার কোন সুফল আজও মেলেনি।যে কারনে পানির অভাবে দৈনন্দিন কাজে সিমাহীন দূর্ভোগ পোহাচ্ছে ৫০ হাজার পৌরবাসী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,২০২১ সাল হতে পৌর অফিসে প্রকল্পের কোন ফাইল নথিপত্র সংরক্ষিত নেই। প্রকল্প বাস্তবায়ন কালীন (পিডি,টিমলিডার -এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক),(ডিপিডি,সহকারী প্রকৌশলী,উপ-সহকারী প্রকৌশলী, কনসালটেন্ট কৃষ্ণ পদ রায়,স্হানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর,ঢাকা) ও পৌর মেয়র রফিউদ্দিন আহম্মেদ ফেরদৌস সহ ১৭ জন নামমাত্র দায়িত্বে থাকলেও মেয়র আ’ লীগের সভাপতি পদ ব্যবহার করে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সালেককে নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রন করতেন।
নক্সাকার শেলিম মল্লিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও তিনি বলেন,আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে আমি কিছুই জানিনা।প্রকল্পের কাজ সমাপ্তির সন্তোষজনক ক্লিয়ারেন্স দেন পিডি,সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, ঢাকা।
প্রকল্প দেখভালের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল থাকা সত্ত্বেও সকলের যোগসাজসে হয়েছে বিরাট পুকুর চুরি।
পৌরসভার ৭,৮ নং ওয়ার্ডে দু’টি পানির ট্যাংক এর জন্য জমি অধিগ্রহন নিয়েও রয়েছে নানা রকম অনিয়ম আর অর্থ লুট। ৫৩ কোটি ১০ লক্ষ টাকার পানি প্রকল্পের কাজে পুকুর চুরির ঘটনা একাধিক মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে দেখভালের দায়িত্ব প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে অদৃশ্য কারনে কেউ কোন ব্যবস্হা না নিলেও,গত পাঁচ বছর যাবৎ প্রকল্পের ফাইল নথিপত্র গায়েব থাকার কারনে বর্তমান পৌর প্রশাসক আবদুল কাইয়ূম ২৯/৬/২৫ ইং তারিখ সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস ছালেক,নক্সাকার শেলিম মল্লিক ও টিউবওয়েল মেকানিক বাবুল মাতুব্বরকে কারন দর্শাও নোটিশ দিলে অদৃশ্য ইংগিতে ওপেন সিক্রেট ফাইল নথিপত্র উদ্ধার হলেও প্রকল্পের সব তথ্য রয়েছে কি না তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে,২০২৫ সালের জুন মাসে পিরোজপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় পানি (CTEIP) প্রকল্পে দূর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহিত হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি।পৌরবাসী আশা করছে পানি প্রকল্পের তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।
উপজেলার দক্ষিন সোনাখালী গ্রামের আনছার আলী হাওলাদার এর পুত্র মোঃ নজরুল ইসলাম হাওলাদার আক্ষেপ করে জানান,স্ত্রী শিরিন আক্তার’র নামে পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে জেএল -২১ এস এ খতিয়ান -১৭৬, দাগ-৯৭১, ১৪ শতক জমি তৎকালীন আ’লীগ সভাপতি ও পৌর মেয়র রফিউদ্দিন আহম্মেদ ফেরদৌস নানা কৌশলে পানির ট্যাংকের জন্য অধিগ্রহন করেন।শালিস ব্যবস্হা মামলা করেও কোন সুফল না পেয়ে অনুপায় হয়ে সামান্য মূল্য নিয়ে বিদায় হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভার একাধিক সূত্র জানিয়েছে,৩০ বছর স্হায়িত্ব সম্পন্ন নতুন উন্নত মানের ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ৮ মিঃ মিঃ পুরু ও ১২ ইঞ্চি ব্যাসের নতুন এম এস পাইপ ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও ঢাকার ধোলাইখাল পাড় থেকে ব্যবহৃত পুরাতন নিম্নমানের পাইপসহ ফিটিংস ক্রয় করে জোড়াতালি রং মাখিয়ে ব্যবহারের কারনে দুই বছর যেতে না যেতেই পাইপের লিকেজ সমস্যার সংষ্কার কাজ শুরু হয়।
পৌরসভা থেকে সরবরাহকৃত তথ্যে পাইপ সংষ্কার করতে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ও প্রতিদিন ৫ লক্ষ লিটার পানি অপচয়ের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা আরো বেশি হবে বলে জানা গেছে।পানির সরবরাহের দায়িত্বে থাকা একাধিক ব্যক্তি জানান, সংষ্কার না হলে যে কোন সময় পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরো জানায়,কাজের শুরুতে নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহার সম্পর্কে তৎকালীন পৌর কর্তৃপক্ষের নজরে আনার বহু চেষ্টা করেও কোন সুফল মেলেনি বরং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে আর চাকুরী হারানোর শঙ্কা ছিল প্রকল্প চলাকালীন সময়।
দুই বছরান্তে পানি প্রকল্পে ত্রুটি দেখা দিলে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস ছালেক,সাবেক প্রশাসক আরিফ উল হককে ম্যানেজ করে সটকে পরেন।এখন অনেকে বদলী চেষ্টায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে,বরিশালের মুলাদী পৌরসভায় কর্মরত সাবেক পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ ও নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস ছালেক বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২১ নং ওয়ার্ডের মুন্সীর গ্রেজ মুসলিম গোরস্তান রোডে ১৪ শতক জমি জুড়ে “সূর্য্য দীঘল বাড়ি” নামে যৌথ একটি ৮ তলা ফ্লাট বাড়ি নির্মান করেছেন।
এ দিকে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ শুন্য থাকায় মঠবাড়িয়া পৌরসভার উন্নয়ন কাজ ব্যহত হচ্ছে।
কনসালটেন্ট কৃষ্ণ পদ রায় নিজের দায় এড়িয়ে বলেন,”কাজের শেষ পর্যন্ত আমি ছিলাম না।”
মঠবাড়িয়া পৌরসভার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস ছালেক কে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।
সাবেক পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন,প্রকল্পের সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
কর আদায়কারী ও অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ওযাটার সুপাভাইজার মনিরুজ্জামান বলেন,”পানির পাইপে লিকেজ থাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮ লক্ষ লিটার পানি অপচয় হচ্ছে।লিকেজ সমস্যা বাড়ছে।দ্রুত সংষ্কার না হলে পৌরবাসী বড় ধরনের পানি সংকটে পরবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে।”
পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল কাইয়ূম বলেন,”পানির পাইপে লিকেজ সমস্যার কারনে পানি অপচয় হচ্ছে।প্রতিদিন সংষ্কার চলছে,আমরা সর্বোচ্চটা করে যাচ্ছি।”