বাজেট কথাটি আলোচনায় এলে আমাদের কল্পনায় যে চিত্রটি প্রথম আসে সেটি হচ্ছে- অর্থমন্ত্রী পরিপাটি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি কালো ব্রিফকেস হাতে সংসদ অধিবেশন কক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আসলে কী থাকে এ কালো ব্রিফকেসে? কীইবা এর মাহাত্ম্য?
কালো ব্রিফকেসের মাহাত্ম্য জানতে হলে চলে যেতে হবে বাজেট শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে। নর্মানদের কল্যাণে ফরাসি ভাষা বুজেট থেকে ইংরেজি ভাষায় বাজেট শব্দটির আগমন। বাজেট শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘টাকার থলি’ কিংবা ‘মানিব্যাগ’।
সময়টা আঠারোশ’ শতক। ইংল্যান্ডের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ছিলেন রবার্ট ওয়ালপুল। ১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত তিনি দেশটির অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে বিভিন্ন মহল থেকে কর কমানো, বাড়ানো, নানা ধরনের সলাপরামর্শের চিরকুট আসত তার কাছে। তিনি সেসব চিরকুট নিজের মানিব্যাগে রেখে দিতেন। পরবর্তীতে বাজেটের সময়ে এসব চিরকুটের সলাপরামর্শ ও দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে তিনি বাজেট প্রণয়ন করতেন- যেখানে সব মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করা হতো।
এই যে মানিব্যাগে বাজেটের নানা প্রস্তাব লুকিয়ে রাখা- এটিই ছিল কালো ব্রিফকেসের সূতিকাগার। শিল্পবিপ্লবের পরে যুক্তরাজ্যের বাজেটসহ ইউরোপের বাজেট বড় হতে শুরু করে। তখন আর মানিব্যাগে চিরকুট নিয়ে নয়, বাজেটের নানা প্রস্তাব ও পরামর্শের জন্য দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের রীতিমতো ব্রিফকেস কিনতে হয়েছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাজেট প্রণয়নে ব্রিফকেস হয়ে উঠেছে বাজেট সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ
এ ছাড়াও একটি দেশের বাজেট ওই দেশের গোপনীয় নথির অন্তর্ভুক্ত- বিশেষ করে উত্থাপনের আগ পর্যন্ত। যদি কোনো ব্যবসায়ী কিংবা প্রতিষ্ঠান আগে থেকে জেনে যায় আগামী বাজেটে কী কী পরিবর্তন আসছে- তারা সে সুযোগটি কাজে লাগিয়ে রাতারাতি বড় অঙ্কের মুনাফা কামিয়ে ফেলতে সক্ষম। কাজেই সংসদে বাজেট পেশের আগে বাজেটের বিষয়সমূহ গোপন রাখতে হয়। বলা হয়ে থাকে, যে অর্থমন্ত্রী তার বাজেটের গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারেন না, তার পক্ষে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে অর্থমন্ত্রী দ্বারস্থ হোন লকড ব্রিফকেসের। আর এভাবেই ব্রিফকেস হয়ে ওঠে বাজেটের প্রাগৈতিহাসিক সঙ্গী।
বাজেট গোপন রাখতে না পারার কারণে ১৯৪৭ সালে যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী হিউ ডালটনকে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। বাজেট পেশের আগে সাংবাদিকরা যখন হিউকে বাজেট সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন করেন, তিনি গোপন কিছু তথ্য সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দেন। এতে করে বাজেট উত্থাপনের আগেই সংসদ সদস্য ও সাধারণদের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে যায়। শেষমেশ স্থগিত করতে হয় বাজেট উত্থাপন। পদত্যাগ করেন অর্থমন্ত্রী হিউ ডালটন।
একটা সময় ছিল, অনেক দেশে বাজেটের আগের সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য কর্মকর্তাদের একটি হোটেল কক্ষে প্রায় বন্দি অবস্থায় রাখা হতো। তাদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হতো না। হোটেল কক্ষেই তারা বাজেট গঠন করতেন ও সংসদে উত্থাপনের পরে বাড়ি ফিরতে পারতেন।
তবে এখন সময় বদলে গেছে। নানামুখী স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাজেটে সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা হয়। বাজেটের আগে দফায় দফায় অনুষ্ঠিত হয় নানামুখী আলোচনা সভা। এরপরে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা আলোচনা শেষে প্রস্তুত করেন পুরো অর্থবছরের বাজেট। আর সেই বাজেট কালো ব্রিফকেসে পুরে অর্থমন্ত্রী প্রবেশ করেন সংসদে, উত্থাপন করেন বাজেট।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে আগামী ৯ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করবেন। ইতোমধ্যে গত ৫ জুন থেকে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট পেশ করবেন। অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, বৈশ্বিক সংকটের দিকে নজর রেখে নতুন বাজেটে স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও থাকবে।