

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী (বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে) কর্মসংস্থান সংকট, দক্ষতার ঘাটতি এবং টেকসই অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
তাছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির খাত খতিয়ে দেখলে আমরা কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপারটা অনুধাবন করা অনেকটা সহজ হবে।
দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরির খাত” বা প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী, সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত শিক্ষক, ব্যাংক ও সংস্থা, ইত্যাদি। এর পরিমাণ মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে খুবই সীমিত, প্রায় ৫%
বেসরকারি” বা অপ্রাতিষ্ঠানিক” খাত বলতে বোঝায় সেই কর্মসংস্থান যা সাধারণত formal চুক্তি ছাড়া, শ্রম সুরক্ষা ছাড়া, অনেক সময় অস্থায়ী/আংশিক বা নিজ উদ্যোগে হয়। এই খাতে কর্মরতদের অংশ মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮৪–৯৫%
আর্থিক ও সামাজিক জীবনে আমাদের দেশের “বেকারত্ব” একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। বেকারত্বের কারনে তারুণ্যের সব সম্ভাবনা নষ্ট করে দিচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়াটা বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দৈনিক প্রথম আলো রিপোর্ট অনুযায়ী
৫ বছরে উচ্চশিক্ষিত বেকার দ্বিগুণ, কর্মসংস্থান নিয়ে তরুণদের উদ্বেগ বাড়ছে
২০১৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ছিলেন ৪ লাখ। ২০২২ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখ।
২০২৪–২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক) অনুযায়ী:
বেকারত্ব হার: ৪.৬৩ %
বেকার সংখ্যাঃ নয় লাখ (২.৭৩ মিলিয়ন) জন ২৭.৩ লাখ লোক
সম্প্রতি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও আপ-টু-ডেট তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সর্বশেষ পাওয়া বেকার সংখ্যা ২৭.৩ লাখ, এবং বেকারত্ব হার ৪.৬৩ %
কিছু বিশ্লেষকদের মতে বাংলাদেশে বেকারত্বের বাস্তব হার অফিসিয়াল তথ্যের চেয়েও অনেক অনেক বেশি।
দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪০ ভাগ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বসবাস করছে। বেকারত্ব সমস্য দূর করনের লক্ষ্যে বহু অর্থনীতিবিদ গবেষক এবং বিশ্লেষক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিকনির্দেশনা তথ্যবহুল আলোচনা এবং দিক নির্দেশনা আছে। আমি সেদিকে না গিয়ে শুধু কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বেকারত্বের উত্তোলনের সুফল গুলো ব্যাখ্যা করছি।
এবার আসুন বাংলাদেশের আয়ের প্রধান দুটি খাত উপর আলোচনা করি।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে বর্তমানে কর্মরত মানুষের পরিমাণের সর্বাধিক আপডেটেড ও বিশ্বাসযোগ্য রেঞ্জ ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন এর মধ্যে। সরকারি বক্তব্য অনুসারে সংখ্যা ৫০ লাখও ছাড়িয়েছে।
বিশ্বে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সামগ্রীর বিশাল বাজার রয়েছে কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা পোশাক তৈরির জন্য যে মেটেরিয়াল গুলা দরকার সেটাও আমরা উৎপাদন করতে পারিনা।এমনকি পোশাকের সুতা কিংবা বোতামগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের পোশাকের সরঞ্জামাদি বিশেষ করে সুতা বোতাম এ জাতীয় জিনিসগুলো কেন দেশে তৈরি করতে পারি না?
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের আয়ের যোগান দিচ্ছে বৈদেশিক রেমিট্যান্স(GDP)
যদি ২০২৪ ২৫ সালের পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী ব্বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রায় ৫% থেকে ৭%
কিছু প্রতিষ্ঠানের হিসেবে ৬–৮% পর্যন্তও উঠতে পারে বলে ধারণা করছেন।
দেশের শিক্ষিত জনশক্তি বেকারত্বের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন কর্মসংস্থানের জন্য। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি নিয়ে এই সমস্ত প্রবাসীদের বেশির ভাগই সাধারণ লেবার কাজ করছেন কিংবা ট্যাক্সি চালাচ্ছেন। অথচ ওই প্রবাসীরা যদি কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতেন তাহলে তাদের জীবনযাত্রার মান বহুগুনে উন্নত হতো। কর্ম দক্ষতা অনুযায়ী তাদের ইনকাম অনেক উপরে থাকত যা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে GDP পরিমাণ অনেক আংশে বৃদ্ধি পেত।
সুতরাং উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি বর্তমান কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা উপর বেশি করে প্রাধান্য দিতে পারলে দেশের বেকারত্ব কমাতে সক্ষম ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করি।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে চায়নাতে আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিয়ে নিয়ে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে আজকে চায়না প্রতিটি ঘরে এক একটি কারখানা তৈরি হয়েছে। বলতে গেলে পণ্য বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বিশ্বের অত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ মানুষ ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো চায়নার সামগ্রী ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
সুতরাং বাংলাদেশের বেকারত্ব দূর করার জন্য কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকার এবং সাধারণ জনগণ গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করতে হবে।
কারিগরি শিক্ষা কেন দরকার?
কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো পেশাগত দক্ষতা (যেমন: ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, অটোমোবাইল মেকানিক, গ্রাফিক ডিজাইনার ইত্যাদি) অর্জন করে।
এর সুবিধা: চাকরির সুযোগ বাড়ে – দেশ এবং বিদেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা অনেক।
আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ: – নিজের ব্যবসা শুরু করা যায়।
শিক্ষা শেষে দ্রুত আয়:- ডিগ্রি শেষ করার পরই উপার্জন শুরু করা সম্ভব।
সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষার বিষয়সমূহ (বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে)
১. ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স টেকনোলজি
চাকরি: বিদ্যুৎ, টেলিকম, কনস্ট্রাকশন সেক্টরে
বিদেশে উচ্চ চাহিদা (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে)
২. কম্পিউটার ও আইটি টেকনোলজি:
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার, ডিজিটাল মার্কেটিং
ফ্রিল্যান্সিংয়ের বড় ক্ষেত্র
৩. মেকানিক্যাল টেকনোলজি
ফ্যাক্টরি, গাড়ি মেরামত, মেশিনারিজ
দেশ-বিদেশে চাকরির সুযোগ
৪. রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং (RAC)
ঘরোয়া ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে প্রচুর চাহিদা
বিদেশেও এই ট্রেডে প্রচুর নিয়োগ হয়
৫. ড্রেস মেকিং ও গার্মেন্টস টেকনোলজি
বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে বিশাল চাহিদা
উদ্যোক্তা হওয়ারও সুযোগ
৬. ওয়েল্ডিং ও ফেব্রিকেশন টেকনোলজি
নির্মাণ ও ভারী শিল্পে ব্যবহৃত
মধ্যপ্রাচ্যে অনেক চাহিদা
৭. ফার্মেসি ও হেলথ টেকনোলজি
হাসপাতাল, ক্লিনিক, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি
চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে
৮. ফুড প্রসেসিং ও বেকারি টেকনোলজি
খাদ্য শিল্পে দ্রুত প্রবৃদ্ধি
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার ভালো সুযোগ
৯. ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট
হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ভ্রমণ শিল্পে
আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেশি
১০. গ্রাফিক ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া
ফ্রিল্যান্সিং ও মিডিয়া শিল্পে চাহিদা
ক্রিয়েটিভদের জন্য
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১০০০ কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
আনুমানিক সংখ্যা
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ৫০০+ টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (TSC)৬৪+ ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (VTI) ৪০০+ টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (TTC) ৭০+
বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার—সকলের পক্ষ থেকেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে:
বর্তমান চালু ওই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার মান উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন:
১. শিক্ষার মান উন্নয়ন;
আধুনিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন: প্রযুক্তি ও শিল্পের পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিকুলাম তৈরি করা।
কার্যকর প্রশিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ : প্রশিক্ষকদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নতুন প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলা।
অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতির আধুনিকায়ন : পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি দক্ষতা মূল্যায়ন (skill-based assessment) চালু করা।
২. শিল্পের সাথে সমন্বয়;
ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া পার্টনারশিপ : স্থানীয় শিল্প কারখানা ও কোম্পানির সাথে টিভেট (TVET) প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
ইন্টার্নশিপ ও অন-জব ট্রেনিং : শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া।
৩. প্রযুক্তি সংযোজন;
ডিজিটাল ল্যাব ও স্মার্ট ক্লাসরুম: কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক সরঞ্জাম ও সফটওয়্যার সংযুক্ত করা।
অনলাইন ও হাইব্রিড কোর্স: ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ।
৪. সামাজিক সচেতনতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি:
কারিগরি শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া।
ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং**: শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও দক্ষতা অনুযায়ী উপযুক্ত ট্রেড নির্বাচন করতে সহায়তা করা।
৫. উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান;
ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ: আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান।
সরকারি সহায়তা ও ঋণ সুবিধা: কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ বা অনুদান প্রদান।
৬. নীতিমালা ও প্রশাসনিক সহযোগিতা;
কারিগরি শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা।
প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি : বাজেটে কারিগরি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা।
সকল দিক বিবেচনা করে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি দক্ষতা অর্জন করা প্রসার করা বাংলাদেশের বেকারত্ব দূর করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
পরিশেষে বলবো বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস সবসময় বলেন অন্যের কাজ করা চিন্তা ঠিক নয়।
নিচে কর্ম প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলো যাতে অন্যের কর্মসংস্থান করে দিতে পারো। সুতরাং কর্মসংস্থান গড়ার জন্য আমাদেরকে আমাদের জাতিকে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার উপর অধিক তরে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সরকারকে বিশেষ খাতে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। প্রবাসে অবস্থানরত বিত্তবানদের তাদের নিজ এলাকায় কারিগরিব শিক্ষার ব্যাপারটা ব্যাপারে গরিব জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
মনে রাখবেন আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বিকারীকে ভিক্ষা দেন নাই তার জামা বিক্রি করে কোটার কিনে দিয়েছিলেন যাতে করে সে কর্ম করে খেতে পারে।
মিসবাহ রহমান
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী