• আজ ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শরণার্থী থেকে নায়করাজ রাজ্জাক

| নিউজ রুম এডিটর ৫:২০ অপরাহ্ণ | আগস্ট ২১, ২০২২ বিনোদন

কলকাতার খানপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক বালককে তার শিক্ষক সিলেক্ট করেন স্কুলের অনুষ্ঠানের এক নাটকের জন্য। সেই বালককে নাটকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। সরস্বতী পূজা উপলক্ষে স্কুলে অনুষ্ঠিত মঞ্চনাটকের মধ্য দিয়েই অভিনয়ের শুরু। এরপর দীর্ঘ পথচলা। সপ্তম শ্রেণির সেই বালকটি হলো নায়করাজ রাজ্জাক।

ষাটের দশকে উপমহাদেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে জীবন বাঁচাতে ১৯৬৪ সালে কলকাতা ছেড়ে স্ত্রী লক্ষ্মী ও শিশুপুত্র বাপ্পাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন রাজ্জাক। ঢাকার কমলাপুরে মাসিক ৮০ টাকা ভাড়ায় ছোট্ট এক ঘর থেকে শূন্য হাতে শুরু করেছিলেন জীবনসংগ্রাম। তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামে একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকের কাছে খানিকটা পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ আসে তার হাতে। এর পর ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ সিনেমায় একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বড় পর্দায় রাজ্জাকের আবির্ভাব। তখনও ভাগ্য পুরোপুরি খোলেনি। বেশ কিছু সময় পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। সে সময়ের চড়াই-উতরাইয়ে পাশে ছিলেন তার স্ত্রী লক্ষ্মী।

একদিন ভাগ্যক্রমে বড় পর্দায় নায়ক হওয়ার সুযোগ চলে আসে রাজ্জাকের কাছে। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ সিনেমা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। এই সুপারহিট সিনেমার পর ঢাকার সিনেমায় নায়কের খাতায় যোগ হয় নায়ক রাজ্জাকের নাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে নির্মিত বেশির ভাগ সিনেমার নায়ক ছিলেন রাজ্জাক।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তায়, তাদের একজন নায়ক রাজ্জাক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তি পায় তার অভিনীত ‘মানুষের মন’ সিনেমা। এ সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নতুনভাবে জেগে ওঠে। সূচনা হয় নায়ক রাজ্জাকের যুগ। তার অভিনীত চলচ্চিত্রে একদিকে যেমন ছিল প্রেম ভালোবাসা, অন্যদিকে বিরহও।

১৯৭৩ সালে রাজ্জাকের ‘রংবাজ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারার সূচনা হয়। শুরু হয় চলচ্চিত্রের আধুনিক অ্যাকশন যুগের। নায়কের পাশাপাশি প্রযোজনায়ও চালিয়েছেন রাজত্ব। ‘বেঈমান’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘অনির্বাণ’, ‘শ্লোগান’, ‘এখানে আকাশ নীল’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ত্রিরত্ন’ তার প্রযোজিত উল্লেখযোগ্য সিনেমা। ১৯৭৭ সালে ‘অনন্ত প্রেম’ সিনেমার মধ্য দিয়ে পরিচালনায়ও দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা।

১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায় শেষ দৃশ্যে মাস্টার সুমনের মৃত্যুর পর পুলিশের খাতায় তার স্বাক্ষর করার দৃশ্যটি দেখে কেঁদে ফেলেছিল দর্শক। একই পরিচালকের ‘ছুটির ঘণ্টা’ সিনেমায় স্কুলের দপ্তরির জন্যও অনেকে তাকে অভিবাদন জানিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার প্রতিবাদে রাজ্জাক বানিয়েছিলেন ‘বাবা কেন চাকর’। এ সিনেমা দেখেও দর্শক আবেগে আপ্লুত হয়েছে।

প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে মিশে আছে নায়ক রাজ্জাকের নাম। তাকে ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস লেখা অসম্ভব। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের দাপট ধরে রেখেছিলেন। সে সময়ের মধ্যে বাঙালি দর্শকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রিয় নায়ক। এত দীর্ঘ সময়জুড়ে আর কোনো নায়ক তার আধিপত্য ধরে রাখতে পারেননি বাংলা চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার মিলেছে জীবদ্দশায়।