• আজ ২৩শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আওয়ামী ফ্যাসিষ্টদের সাথে জড়িত বিএমডির কর্মকর্তারাও

| নিউজ রুম এডিটর ১:২৪ পূর্বাহ্ণ | আগস্ট ৭, ২০২৫ সারাদেশ, সিলেট

 

১১০ কোটি টাকার খনিজ বালি-পাথর সরিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা

বিশেষ প্রতিবেদক:সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে এবার নিলামের আড়ালে বালি পাথর সরকারি মূল্য ও আয়কর ছাড়াই প্রায় ১১০ কোটি টাকার খনিজ বালি পাথর সরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট।

অই সিন্ডিকেটের মূলহোতা যুক্তরাজ্যে পলাতক সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি রনজিত চন্দ্র সরকারের ঘনিষ্ট সহচর আ.লীগ নেতা মোতালেব ওরফে পাথ্থর মোতালেব। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের জাদুকাটা নদী তীরবর্তী ছড়ার পাড় গ্রামের মৃত মহর আলীর ছেলে তিনি।

এছাড়াও উচ্চ আদালত ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)’র কিছু অসৎ দায়িত্বশীলরা এ দুর্নীতির মহোৎসবে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

বুধবার সরজমিনে তাহিরপুরের জাদুকাটা নদী তীরবর্তী এলাকা, লাউরগড় বাজারের উত্তর পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, পূর্ব পাড়া, পার্শ্ববর্তী ঢালার পাড়, ছড়ার পাড়, একাধিক গ্রামের বাড়িতে , সড়কের পাশে, ঝোঁপ-ঝাড়ে, জঙ্গলের ভেতর সারি সারি খনিজ বালি ও নুরী পাথর স্তুপ (ডাম্পিং) করে রাখতে দেখা গেছে।

 


ডাম্পিং করে রাখা এসব খনিজ বালি, পাথরের একাধিক ছবি ও ভিডিও ফুটেজ এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাদুকাটা নদীর বালি মহাল -১, ২ ইজারার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ওই বালি মহাল দুটির ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। গেল কয়েক বছর জাদুকাটার নদীতে পৃথকভাবে খনিজ পাথর মহাল ইজারা দেয়া হয়নি।

আর এ সুযোগ কাজে লাগান আ.লীগ নেতা মোতালেব ওরফে পাথ্থর মোতালেব।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, এক সময়ের লাউড়গড় বাজার তাহিরপুর লাউড়গড় বাজারে টং দোকানে পান বিক্রি করে সংসার চালত মোতালেবের। বালি পাথরের অবৈধ বাণিজ্যের পাশাপাশি তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, সদর মডেল থানার কিছু অসৎ পুলিশ অফিসার , পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসন ম্যানেজের নামে কারবারিদের নিকট থেকে অতীতে আদায় করা চাঁদাবাজির একটি বড় ভাগ পেতেন। এরপর তিনি সরকারি খাঁস ভুমি দখল. হাওরে কেয়ারের পর কেয়ার জায়গা জমি কিনে গাড়ি বাড়ি তৈরি করেন। তার নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে পড়ে আছে কাড়ি কাড়ি টাকা। তিনি এখন অর্ধশত কোটি টাকার মালিক।

কথিত পাথর সমিতির সভাপতি রনজিত চন্দ্র সরকারের ছায়াতলে মোতালেব স্থানীয় বালি পাথর কারবারিকে ব্যবহার করে জাদুকাটার নদীর উৎসমুখ ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে পাথর (বোল্ডার) আনতে থাকেন। একই সাথে জাদুকাটা নদীর চর, পাড় (তীর) আশপাশের এলাকা, সরকারি খাস বালি ভূমি থেকে শতাধিক ড্রেজার, বোমা, সেইভ মেশিনে, কোয়ারি করে উত্তোলন করাতে থাকেন খনিজ সিঙ্গেল (নুরী পাথর), (বোল্ডার) পাথর ও বালি।

 

এভাবে প্রায় ওই সব গ্রাম, নদীর পাড়, স্কুলের পাশে, সড়কের পাশে বসতবাড়ির ভেতর-বাইরে ঝোঁপ ঝাড়ে, জঙ্গলে ডাম্পিং করানো হয় প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ ঘনফুট সিঙ্গেল (নুরী পাথর) ৯ থেকে ১০ লাখ ঘনফুট পাথর বোল্ডার), ১ কোটি ঘনফুট খনিজ বালি।

অবৈধভাবে সংগৃহীত এসব খনিজ বালির বাজার মূল্য রয়েছে সরকারি ভ্যাট আয়কর ছাড়াই প্র্ায় ১০০ থেকে ১১০ কোটি টাকা।

মোতালেব চক্র প্রশাসনকে চাপে রেখে খনিজ বালি পাথর প্রথম ধাপে কৌশলে সরিয়ে নিতে কয়েকমাস পূর্বে কারবারি, শ্রমিকদের জড়ো করে মানববন্ধনের আয়োজন করান। যা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

দ্বিতীয় ধাপের কৌশল হিসেবে এলাকায় কাজের অভাবে চুরি ডাকাতি, ছিনতাই বেড়েছে বলে সামাজিকমাধ্যমে ভিডিও ছড়ান মোতালেব একই সাথে জাদুকাটা নদী খুলের দেয়ার দাবিতে গুজব রটায় মোতালেব চক্র।

এসব করেও ব্যর্থ হয় মোতালেব ও তার বালি পাথর খেকো সঙ্গীরা।

সূত্র জানায়, এরপর মোতালেব আড়ালে থেকে তার অনুসারী আওয়ামী-বিএনপি বলয়ের দুই কারবারিসহ দালালচক্রের সহযোগিতায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) গুটি কয়েক দায়িত্বশীল অসৎ অফিসারকে ঘুসের বান্ডিল দিয়ে ম্যানেজ করেন।
মোতালেব চক্রের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএমডি থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসে জাদুকাটা নদীর তীরে লাউড়গড় বাজার (দক্ষিণ-পশ্চিম) দিকে এক হত দরিদ্র কারবারির প্রায় ৫৪৯৩ ঘনফুট পাথর জব্দ করেন।
এরপর গেল ২৩ জুলাই তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হলরুমে বিএমডির উপ-পরিচালক (সংযুক্ত) মো: মামুনুর রশীদ উন্মুক্ত নিলামের আয়োজন করেন। মোতালেব চক্রের কয়েকজন সিন্ডিকেট প্রথায় সিডিউল কেনেন। অই নিলামের আড়ালে ১১০ কোটি টাকার খনিজ বালি পাথর সরিয়ে নেয়ার ফাঁদ পাতেন তারা। বিষয়টি জানাজানি হলে সেদিনের নিলাম স্থগিত করা হয়।

পরে ফের বিএমডি থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে লাউড়গড় বাজারের আরো এক কারবারির ৫২৫০ ঘনফুট পাথর জব্দ করানো হয়।

এসময় স্থানীয় লোকজন বিএমডির ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে মোতালের বাড়িতে, ঢালার পাড়ের আওয়ামী লীগ নেতা বিল্লাল হোসেন, একই গ্রামের বিএনপি নেতা রহিছ মিয়ার বাড়িসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের বাড়ি, সড়কের পাশে , ঝোঁপ ঝাড়, জঙ্গলের ভেতর থাকা লাখ লাখ ঘনফুট খনিজ বালি পাথর জব্দের জন্য ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করে। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেননি তিনি।

অভিযোগ, মোতালের চক্রের কাছ থেকে যাতায়াত বাবদ কয়েক হাজার টাকা পকেটে নিয়ে ফিরে যান ওই ম্যাজিস্ট্রেট।

এ ঘটনায় জনরোষ বাড়ে। স্থানীয়দের ক্ষোভের মুখে পড়ে মোতালেব চক্র গত ৩ আগস্ট ১০ হাজার ৭৪৩ ঘনফুট পাথর জব্দ দেখিয়ে এবার বিএমডির উপ-পরিচালক (সংযুক্ত) মো: মামুনুর রশীদকে দিয়ে নিলামের আয়োজন করান। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের হলরুমে এ নিলামের আয়োজন হয়।
ওই দিনের নিলামও স্থগিত হয়। পরে বিএমডির মামুনুর রশীদ কয়েক লাখ টাকার পাথর জব্দ দেখিয়ে ফের নিলামের ঘোষণা দেন। বৃহস্পতিবার( ৭ আগস্ট) সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের হলরুমে হবে সেই নিলাম।

স্থানীয় কারবারিদের অভিযোগ, মোতালেব চক্র এ নিলাম বাগিয়ে আনতে পালে নিলামের কাগহ বার বার দেখিয়ে সময় বৃদ্ধি করে কয়েকমাস এলাকার সমস্ত বালি পাথরের উপর কয়েক কোটি টাকা চাঁদা নির্ধারন করবে, তারপর সড়ক পথে পাথরের নিচে, নৌ পথে পাথরের নিচে খনিজ বালি রেখে কৌমলে সরিয়ে নেবে সরকারি মুল্য ভ্যাট আয়কর ছাড়াই ১১০ কোটি টাকার খনিজ বালি পাথর। আরো অভিযোগ উঠে মোতালের নদীর পাড়ে, গ্রামের ভেতর শতাধিক পাথর ভাঙ্গার মেশিন বসিয়ে চাঁদা বাদায় করাতেন আবার বিভিন্ন থানা পুরিশ , প্রশাসকে ম্যানেজ করার কথা বলে সমিতির দোহাই দিয়ে আরো এক দঢা চাঁদা আদায় করাতেন নিজস্ব লোকবল দিয়ে।

বুধবার তাহিরপুরের ছড়ার পাড় গ্রামের মোতালেবের নিকট এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেকে তিনি জাদুকাটা বোল্ডার পাথর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি সমবায় সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় আ, লীগ নেতা দাবি করে বলেন, আমি পান দোকানদারী করিনি বরং লাউরগড় বাজারে মুদি দোকানদারী, পল্লী চিকিৎসক হিসাবে ডাক্তারি করতাম। চাঁদা তোলা, বালি পাথর সিন্ডিক্যাটের সাথে জড়িত নয় দাবি করলেও এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ডিসি অফিসে ৭ আগষ্ট জব্দকৃত পাথর বিএমডি থেকে উন্মুক্ত নিলাম হবে। নিজ বাড়িতে পাথর বোল্ডার ও পাথর ভাঙ্গার মেশিন নেই, চার চাকার গাড়িটি ছেলের শশুড় বাড়ি থেকে উপহার পেয়েছেন বলেও জানন মোতালেব।

সুনামগঞ্জ-১ আসনের পলাতক সাবেক এমপি রনজিত চন্দ্র সরকারের ঘনিষ্ট সহচর আ.লীগ নেতা মোতালেব ওরফে পাথ্থর মোতালেব। অভিযোগ উঠেছে, ওই নিলামের আড়ালে মোতালের চক্রের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা ঘুস আদায় জায়েজ করতে ফের ১১০ কোটি টাকার খনিজ বালি পাথর সরিয়ে নেয়ার ফাঁদ তৈরি করেছেন মামুনুর রশীদসহ বিএমডির কয়েকজন অসৎ অফিসার।

বুধবার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যূরো (বিএমডি)’র উপ-পরিচালক মো: মামুনুর রশীদের কাছে জব্দকৃত খনিজ পাথরের পরিমাণ ও নিলামকান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ডিজি স্যার, পরিচালক ছারোয়ার হোসেন স্যার এসব জানেন। বিএমডির ম্যাজিস্ট্রেট দু’বারে ১০ হাজার ৭৪৩ ঘনফুট পাথর জব্দ করেছেন।

আরো অধিক পরিমাণ পাথর সিঙ্গেল বোল্ডার থাকার পরও কেন জব্দ করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

বুধবার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যূরো’র মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আনোয়ারুল কবীরের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিবার কল করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।