• আজ ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজনীতি

তারেক রহমানের দেশে না-ফেরা: সংকট, নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশের রাজনীতির অদৃশ্য সমীকরণ

| Peoples News ৯:২০ অপরাহ্ণ | ডিসেম্বর ১, ২০২৫ বিএনপি, রাজনীতি

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে দুটি পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বের প্রভাব ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই পরিবারেরই রাজনীতি সক্রিয়তায় টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন; অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। ফলে রাজনৈতিক সঙ্কটে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরছেন না কেন?

এই প্রশ্নের কেন্দ্রে রয়েছে তাঁর সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাস, যেখানে তিনি বলেছেন- “সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।” একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত যদি তাঁর নিজের হাতে না থাকে, তাহলে সেই নিয়ন্ত্রণ কার হাতে- এই প্রশ্নই এখন আলোচনার মূল ফোকাস।

১. দৃশ্যমান বাধা নেই, তবুও সিদ্ধান্ত স্থগিত

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৫ মাসে তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমান সব মামলায় আইনি প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি পেয়েছেন। বিএনপি ইতিমধ্যেই তাঁদের নিরাপত্তা ও লজিস্টিক নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে- তিনি চাইলে ‘ওয়ান-টাইম পাস’ দিয়ে স্বল্পসময়ের মধ্যেই দেশে ফিরতে পারবেন।

অর্থাৎ সরকারের দিক থেকে কোনো বাধা নেই। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়- এই সিদ্ধান্তের ওপর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ কীভাবে কাজ করছে?

২. আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টর: যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পশ্চিমা উদ্বেগ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব নতুন নয়। ২০০৭ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন থেকে শুরু করে নির্বাচন, মানবাধিকার ইস্যু, নিরাপত্তা, সহযোগিতা- সব ক্ষেত্রেই বিদেশি শক্তির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তারেক রহমানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই সংশয়পূর্ণ। উইকিলিকসের নথিতেও তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত ছিল। ভারতের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা-সহযোগিতার হিসাবও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া মানে তিনি সেখানকার আইনি কাঠামোর অধীনেও অবস্থান করছেন।

বিএনপির কিছু নেতার মতে, কমপক্ষে দুটি প্রভাবশালী দেশ তাঁর তাৎক্ষণিক প্রত্যাবর্তন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। কারা, কেন এবং কী কারণে- সে বিষয়ে কোনো প্রকাশ্য তথ্য নেই। কিন্তু সজীব ওয়াজেদ জয়ের মন্তব্য- “দুই দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনে বিদেশ থেকে তৎপরতা চলছে”- এ আলোচনাকে আরও জোরদার করেছে।

অর্থাৎ, তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি শুধুই আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; আন্তর্জাতিক স্বার্থ ও সংকেতও সেখানে সক্রিয়।

৩. ১/১১-এর পুরোনো সমঝোতা কি এখনও কার্যকর?

২০০৭ সালে গ্রেপ্তার-বিমুক্তির পর তারেক রহমান রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকার শর্তে দেশত্যাগ করেছিলেন- এমন অভিযোগ অনেক আগেই উঠেছিল। প্রয়াত মওদুদ আহমদের বইয়েও এর ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও এ বিষয়ে কোনো সরকারি নথি বা আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তি নেই।

প্রশ্ন হলো- সেই সম্ভাব্য সমঝোতা বা গোপন অঙ্গীকারের মেয়াদ কি শেষ হয়েছে?
না কি আন্তর্জাতিক মহল এখনও এ সমঝোতাকে কার্যকর মনে করে?

তারেক রহমানের নিজের বক্তব্য-“স্পর্শকাতর বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনার অবকাশ সীমিত”-ইঙ্গিত দেয়, অতীতের কোনো শর্ত বা অঙ্গীকার এখনও তাঁর রাজনৈতিক পথচলাকে প্রভাবিত করছে।

৪. মাইনাস টু সরে এসেছে; আলোচনায় এখন ‘মাইনাস ফোর’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু’ শব্দবন্ধ ব্যবহার হয়েছিল শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বোঝাতে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত লক্ষ্য ছিল দুই পরিবারকেই রাজনীতির কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়া- যা অনেকের ভাষায় ‘মাইনাস ফোর’।

বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করলে-
▪️ শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বিদেশে,
▪️ খালেদা জিয়া রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর,
▪️ তারেক রহমানই দুই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের একমাত্র সক্রিয় মুখ।

তাঁর দেশে না-ফেরা তাই অনেক বিশ্লেষকের কাছে মনে করিয়ে দিচ্ছে রাজনীতির অদৃশ্য মাঠে ‘মাইনাস ফোর’ চিন্তা কি আবার সক্রিয়?

৫. বিএনপির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা ও সিদ্ধান্তের বহুমাত্রিকতা

তারেক রহমানের বক্তব্য প্রমাণ করে- তাঁর দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত বিএনপি এককভাবে নিতে পারছে না। এটি শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতি নয়, বরং অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাকাঠামো, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এবং দলীয় রাজনীতির ভেতরের হিসাব-নিকাশেরও অংশ।

বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা ইঙ্গিত করেছেন- দলের ভেতরে ও বাইরে আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। যদিও কেউই পরিষ্কার করে বলতে চাইছেন না নিয়ন্ত্রণ বা চাপ কোন দিক থেকে আসছে।

এতে স্পষ্ট হয়- তারেক রহমান আজও স্বাধীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবস্থানে নেই।

৬. মানবিক সংকট বনাম রাজনৈতিক বাস্তবতা

খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার খবর সামনে আসার পর সামাজিক মাধ্যমে আবেগময় আহ্বান উঠেছিল- ছেলের দেশে ফিরে মায়ের পাশে থাকা উচিত। দলের ভেতরেও অনেকেই মনে করেছিলেন, তিনি এবার ফিরবেন।

কিন্তু তাঁর স্ট্যাটাসে ফুটে ওঠা অসহায়তা দেখায়- মানবিক টান থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বাস্তবতার বাঁধন আরও কঠিন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তির মানবিক সিদ্ধান্তকেও রাজনৈতিক সমীকরণের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়- এই বাস্তবতা নতুন করে সামনে এসেছে।

৭. নির্বাচন সামনে- ফেরা কি তখন নিশ্চিত?

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বারবার বলছেন- নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। এটি কেবল রাজনৈতিক ঘোষণা নয়; বরং একটি কৌশলগত সংকেত। এর মানে হতে পারে:
▪️ আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনকালীন সময়ে ভিন্ন অবস্থান নেবে।
▪️ তাঁর প্রত্যাবর্তনকে তখন বৈধ বা প্রয়োজনীয় মনে করা হবে।
▪️ দলীয় রাজনীতির জন্য তখন তাঁর উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে উঠবে।

কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তিনি যেন অদৃশ্য একটি রাজনৈতিক “হোল্ডিং প্যাটার্ন”-এ আটকে আছেন।

শেষকথা: সিদ্ধান্তের ক্ষমতা কোথায়?

তারেক রহমান কেন ফিরছেন না- এই প্রশ্নের উত্তর কেবল একটি রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো, আন্তর্জাতিক ভূমিকা, এবং দুই পরিবারের নেতৃত্বসঙ্কট- সবই মিলিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক ধাঁধার অংশ।

আজকের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো-
▪️ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আসলে কোথায় কেন্দ্রীভূত?
▪️ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কোন শক্তি সর্বশেষ কথা বলে?

তারেক রহমানের দেশে না-ফেরা সেই বৃহত্তর প্রশ্নেরই আরেকটি প্রতিচ্ছবি।

লায়ন ড. এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

পিএন / বিএনপি তারেক রহমান