• আজ ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ডিজিটাল আসক্তি : সমাজ কোন পথে?

| নিউজ রুম এডিটর ১:০৯ অপরাহ্ণ | মে ২৫, ২০২৫ ফিচার

 

একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় প্রযুক্তির শতাব্দী। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রা যেমন সহজ ও গতিশীল হয়েছে, তেমনি তৈরি হয়েছে কিছু অদৃশ্য শৃঙ্খল, যা আমাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো—সোশ্যাল মিডিয়া নামক নীরব আসক্তি।

প্রযুক্তির হাত ধরে আমাদের জীবনে এসেছে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাটসহ নানা মাধ্যম। একসময় যা ছিল যোগাযোগের সহজ উপায়, আজ তা অনেকের কাছে একটি অবিচ্ছেদ্য আসক্তি। অনেকে বলেন, এটা আধুনিক যুগের মাদক—যা মানবমস্তিষ্ক ও মূল্যবোধকে আস্তে আস্তে গ্রাস করছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার আদিপর্ব ও বর্তমান বিপর্যয়:

প্রথমদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট—মানুষের মধ্যে দূরত্ব কমানো, তথ্য আদান-প্রদান সহজতর করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা গড়ে তোলা।

কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এই প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে ‘জীবনের বিকল্প জগৎ’। দিনের শুরু এবং শেষ হয় স্ক্রিন দেখে, মনের ভাব প্রকাশ, আবেগের বহিঃপ্রকাশ—সবকিছু এখন মোবাইল স্ক্রিনেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবতা ছাপিয়ে মানুষের মনোজগতে তৈরি হয়েছে এক কৃত্রিম জগৎ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি—সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডিকশন।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি:

মানবমস্তিষ্কে “ডোপামিন” নামক একটি হরমোন নিঃসরণ হয় যখন আমরা কোনো আনন্দদায়ক কিছু পাই। সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ইত্যাদি ছোট ছোট প্রতিক্রিয়া আমাদের ব্রেনে অল্প সময়ের জন্য সুখের অনুভূতি তৈরি করে, যা আমাদের বারবার এই মাধ্যমগুলোতে ফিরে যেতে বাধ্য করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যা কোকেইন বা হেরোইনের মতো মাদক গ্রহণে হয়। ফলে এটি নেশায় পরিণত হয়, যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।

সোশ্যাল মিডিয়ার ভয়াবহ প্রভাবসমূহ:

১. মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মপরিচয়ের সংকট

অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, অন্যের সাজানো জীবন দেখে নিজের জীবনের প্রতি হতাশা জন্ম নেয়। “FOMO” (Fear of Missing Out), “Comparison Syndrome” ইত্যাদির কারণে বাড়ছে উদ্বেগ, হতাশা, আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও আত্মহত্যার প্রবণতা।

২. বাস্তব সম্পর্কের অবক্ষয়:

ঘনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। বাবা-মা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও জায়গা নিচ্ছে নীরবতা ও একাকীত্ব। দেখা যায়—এক টেবিলে বসে সবাই ফোনে ব্যস্ত, মুখোমুখি কথা নেই।

৩. শিক্ষাজীবন ও কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব:

ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে, কর্মজীবীরা অফিসে দায়িত্বে অবহেলা করছে, যার ফলে Productivity ও Creativity কমে যাচ্ছে।

৪. সমাজে তথ্যদূষণ ও গুজবের বিস্তার:

একটি ভুয়া খবর মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। এতে রাজনৈতিক বিভক্তি, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, সহিংসতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।

৫. শিশু ও কিশোরদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে:

বয়সের আগেই মোবাইল হাতে পাচ্ছে শিশুরা। ফলে তাদের চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি, ভাষাগত দক্ষতা ও সামাজিক মূল্যবোধে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।

ভার্চুয়াল সেলিব্রিটি সংস্কৃতি ও আত্মমর্যাদাহীন প্রজন্ম :

বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম প্রভাবিত হচ্ছে বিভিন্ন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইনফ্লুয়েন্সারদের দ্বারা। তারা দেখে চমকপ্রদ সাজানো জীবন, অথচ বুঝতে পারে না এর পিছনের বাস্তবতা। ফলস্বরূপ তৈরি হয় আত্মতৃপ্তির অভাব, হীনমন্যতা ও অনুকরণের ক্ষতিকর প্রবণতা।

ভাইরাল হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা :

বর্তমানে অনেকেই ভাইরাল হওয়ার জন্য অশ্লীল, মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিকর কনটেন্ট ছড়াচ্ছে। এটি নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক শৃঙ্খলার প্রতি চরম অবহেলা।

এই প্রবণতা একটি সমাজকে ধীরে ধীরে অনৈতিকতার অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে।

আইনি কাঠামো ও বাস্তবতা :

যদিও দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে, কিন্তু এর প্রয়োগ এখনো পর্যাপ্ত নয়। হাজার হাজার ফেক আইডি থেকে সাইবার বুলিং, হ্যাকার আক্রমণ, চরিত্রহনন, ব্ল্যাকমেইল, যৌন হয়রানি ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রযুক্তির লাগামহীন ব্যবহারের ফলে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে।

করণীয়: সচেতন ব্যবহারই মূল পথ

সোশ্যাল মিডিয়া নিজে কোনো সমস্যা নয়, এটি একটি শক্তিশালী টুলস। সমস্যা তখনই হয় যখন মানুষ এটি ব্যবহার না করে, বরং এটি মানুষের মন ও জীবনকে ব্যবহার করতে শুরু করে।

তাই প্রয়োজন—

নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার: নির্দিষ্ট সময় বেঁধে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা।

বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার: পরিবার, বন্ধু ও স্বজনদের সময় দেওয়া।

মননশীল ও শিক্ষনীয় কনটেন্ট দেখা ও তৈরি করা।

সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্স: মাঝে মাঝে বিরতি নেওয়া।

আইন প্রয়োগে কঠোরতা: অনৈতিক ও ক্ষতিকর কনটেন্ট নির্মাতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ।

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনে নতুন এক দ্বার উন্মোচন করেছে—কিন্তু সেটি যেন ‘স্বপ্নের দরজা’ না হয়ে ‘ব্যাধির ফাঁদ’ না হয়। সময় এসেছে নিজেদের আয়নায় নিজেকে দেখার—আমি কি সোশ্যাল মিডিয়ার দাস, না কি একজন সচেতন ব্যবহারকারী?

আমাদের উচিত প্রযুক্তিকে শাসন করা, প্রযুক্তির দাস হয়ে যাওয়া নয়। সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ভারসাম্য রক্ষা করে প্রযুক্তিকে সহযোগী বানালেই আমরা পাব এক মানবিক, সৃজনশীল ও স্বাস্থ্যকর সমাজ।

 

লেখক পরিচিতি:
মো: সাইফুল্লাহ খাঁন
সাংবাদিক ও কলামিস্ট