

মো: সাইফুল্লাহ খাঁন:( সাংবাদিক ও কলামিস্ট) :সময়ের সঙ্গে সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটছে। শহর থেকে গ্রামে, সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরেই এক ভয়াবহ প্রবণতা দেখা দিচ্ছে—বৃদ্ধাশ্রম। যারা একসময় সন্তানদের মুখে হাসি ফুটাতে নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই মা-বাবার শেষ আশ্রয় হয়ে উঠছে নির্জন একটি ঘর, যাকে আমরা ‘বৃদ্ধাশ্রম’ বলি। প্রশ্ন জাগে—এটাই কি আমাদের সাংসারিক মূল্যবোধের পরিণতি? মানুষ কি আসলেই এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে মা-বাবার জন্য একটু সময়, ভালোবাসা আর দায়িত্ব নেওয়ার জায়গাটুকুও আর রাখছে না?
বৃদ্ধাশ্রমের বাস্তবতা
বৃদ্ধাশ্রম আজ শুধু একটি স্থাপনার নাম নয়, এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। সেখানে থাকা প্রতিটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার গল্প আলাদা হলেও ব্যথা একটাই—পরিজনের অবহেলা ও একাকীত্ব।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমগুলো এখন প্রায় পূর্ণ। সেখানে কেউ এসেছেন সন্তানের অনুরোধে, কেউ অবহেলিত হয়ে, কেউ বা একান্ত নিরুপায় হয়ে।
একজন মা যখন বৃদ্ধাশ্রমে যান, তার চোখে থাকে সংসারের স্মৃতি, সন্তানের মুখ। কিন্তু সেখানে পাওয়ার মতো থাকে না সেই চেনা শব্দ, সেই স্নেহের ছায়া। এই চিত্র আমাদের সামাজিক অগ্রগতির চেয়ে আত্মিক ব্যর্থতার চিহ্ন।
পারিবারিক দায়িত্ব: শুধুই কর্তব্য নয়, এটি ভালোবাসার নাম
মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব কেবল একটি সামাজিক রীতি নয়; এটি মানবিকতা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিবেকের প্রশ্ন।
ইসলাম ধর্মে মা-বাবার সেবাকে জান্নাতের চাবিকাঠি বলা হয়েছে।
হিন্দু ধর্মে পিতৃঋণ শোধ করাকে পবিত্র কর্ম ধরা হয়।
খ্রিষ্টান ধর্মেও পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা অন্যতম প্রধান নির্দেশনা।
একজন মানুষ তার জীবনে যত বড় সাফল্যই অর্জন করুক না কেন, যদি সে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার সেই সাফল্য অপূর্ণ থেকে যায়।
বৃদ্ধাশ্রমের পেছনের কারণসমূহ
১. পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া:
যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় মা-বাবা অনেক সময় ‘বোঝা’ মনে হয়।
২. সন্তানদের ব্যস্ত জীবন:
আধুনিক কর্মজীবনে ছুটোছুটি ও কর্পোরেট দৌঁড়ে অনেকেই পরিবারে সময় দিতে পারে না।
৩. আর্থিক নির্ভরশীলতা:
অনেক বাবা-মা অবসরের পর সন্তানদের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, সন্তানদের অসন্তোষ দেখা যায়।
৪. সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়:
ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী মানসিকতা পারিবারিক দায়িত্বকে অস্বীকার করে।
সমাধান ও করণীয়
১. নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা জোরদার করা:
পরিবারে ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের শেখাতে হবে—মা-বাবা কেবল জন্মদাতা নন, তারাই জীবনের প্রথম শিক্ষাগুরু।
২. আইন ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা:
সন্তানদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার জন্য যেমন ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন’ রয়েছে, তেমনি এর প্রয়োগও কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
৩. পারিবারিক সময় বাড়ানো:
সাপ্তাহিক ছুটিতে মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের কথায় মনোযোগী হওয়া, ছোট ছোট আনন্দে তাদের যুক্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি।
৪. মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা:
নাটক, চলচ্চিত্র, পাঠ্যবই ও সামাজিক প্রচার মাধ্যমে পারিবারিক দায়িত্বের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
বৃদ্ধাশ্রম নয়, ভালোবাসার আশ্রয় হোক পরিবার
বৃদ্ধাশ্রম নয়, মা-বাবার শেষ আশ্রয় হওয়া উচিত তাদের সন্তানদের ভালোবাসায় গড়া নিজের ঘর। তারা চাই না বিলাসিতা, কেবল একটু কথা, একটু ছায়া, আর কিছু মুহূর্ত সন্তানদের সঙ্গে কাটানোর।
যারা ছোটবেলায় আমাদের রাত জাগিয়ে ঘুম পাড়াতেন, আমাদের খাওয়াতে নিজের না খেয়ে থাকতেন, সেই মানুষগুলো আজ যেন সমাজে ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে না পড়েন।
বৃদ্ধাশ্রম সমাজের একটি বাস্তবতা হলেও এটি কোনো আদর্শ নয়। আদর্শ হলো—পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা দিয়ে তাদের জীবনের শেষ অধ্যায়টিকে সম্মানের সঙ্গে পূর্ণ করে তোলা।
সন্তানের প্রতি মা-বাবা যেমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে যান, তেমনি তাদের পাওনাও নিঃস্বার্থ দায়িত্ব। তাই বলি, “বৃদ্ধাশ্রম নয়, পারিবারিক দায়িত্ব চাই।” এ দাবি কেবল প্রবীণদের নয়, মানবতার।