

১
একটা মাছি অনেকক্ষণ ধরে উড়ে উড়ে খোকন মিয়ার নাকের উপরে বসছে। বিষয়টি খুবই বিভ্রান্ত কর। মাছি ওড়ার ভোঁ ভোঁ শব্দ আর নাকের উপরে বসে সুড়সুড়ি দেওয়ার কারণেই বারেবারে খোকন মিয়ার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে কয়েকবার মাছিটাকে ওড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সে। মশারির ভেতরের একটি মাছিই যথেষ্ট ঘুম চুটিয়ে দেবার জন্য।
মাওয়া থেকে প্রতি রাতে ইট বুঝাই ট্রাক চালিয়ে ঢাকা নিয়ে আসে খোকন মিয়া। সম্প্রতি খালাসি থেকে ড্রাইভার হয়ে ওস্তাদ নামটা নিজের পদবীতে যুক্ত করেছে।
ভোররাতে নিজের ঘরে ফিরে মশারি টাঙিয়ে দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে নেয় খোকন মিয়া। ঘুমের ভিতর বিভিন্ন বিষয়ের স্বপ্ন দেখতে তার খুব ভালো লাগে। আজকেও স্বপ্নের ভিতর নিজেকে হারিয়ে ফেলার সময় বারে বারে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল নাকের উপরের বসা মাছি টি। বিরক্তি সহকারে উঠে পড়ে খোকন মিয়া। তার চোখ জবা ফুলের মত লাল হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করেন খোকন মিয়ার কোন বদ অভ্যাসের কারণেই তার চোখের এই অবস্থা। কিন্তু খোকন মিয়া চা পান সিগারেট কিছুই খান না। অসময়ে ঘুম ভেঙে গেলে খোকন মিয়ার চোখ অস্বাভাবিক লাল হয়ে ওঠে। ঘুম জড়ানো চোখে বিরক্ত নিয়ে খোকন মিয়া ডাক ছাড়লো -আপন, রুপন। বার কয়েকবার ডাকার পরেও কোথাও থেকে কোন প্রতি উত্তর এলো না। আপন ও রুপণ খোকন মিয়ার দুই ছেলে।
বড় ছেলের বয়স ১০ ছোট ছেলের বয়স সাত। দুটোই চরম বদ। পড়াশুনা তাদের মাথায় না ঢুকলেও দুনিয়ার সকল অপকর্মই সহজে তাদের মাথায় ঢুকে যায়। নিজেদের সৃজনশীলতায় সেই জ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখা উদয় হয়। এবং কোন স্থানে সেই জ্ঞান প্রয়োগ করলে কি রকম বিকৃত মনে তখন শান্তি পাওয়া যাবে তা তাদের ভালো মতই জানা।
ময়লার গাড়ির পাম ছেড়ে তা পঙ্গু করা যে কারো জুতো লুকিয়ে রাখা তাদের কাছে নেহাত ডাল ভাত।
খোকন মিয়ার কোন শাসন বা আদেশ তারা কানে মাখে না। বাপ হিসেবে খোকন মিয়ার ভূমিকা নেহাত তাদের কাছে ক্ষণিকের অতিথির মতন। এতোটুকুন বয়সে তাদের কর্মকাণ্ডে পাড়া-প্রতিবেশীদের বিচার নিত্যদিনের কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। বরং একদিন বিচার না আসলেই অবাক হয় খোকন মিয়া। তার বউ চাকরি করে গার্মেন্টসে। সেও বাড়িতে শুধুমাত্র রাতের অতিথি।
খোকন মিয়ার বউ এর নাম উপমা। সে খিটখিটে মেজাজ প্রকৃতির মেয়ে। কথাবার্তায় কোন প্রকারের রস কষ নেই। গলার স্বর ও রুক্ষ। নয়টা পাঁচটা অফিস এবং তার উপরে ওভারটাইম করে বাড়িতে ফিরে উপমার মেজাজ আরো বিগ্রে থাকে। গরম মাথাতেই খাবার তৈরি ও ঘর গোছানোর কাজ করতে হয় তাকে।
স্বামীর সঙ্গে সুখ দুঃখের আলাপ বা খুনসুটি করার মতন বিলাসী সময় তার নেই।
খোকন মিয়া দু চারবার ডেকেও যখন ছেলেদের সাড়া পেল না তখন উঠে শলার ঝাড়ুটা খোঁজার জন্য তোশকের এপাশ ওপাশ উঁচু করলো। মশারির ভিতরে আটকে পড়া মাছি খুব সহজেই শলার ঝাড়ু দিয়ে মারা সম্ভব। খোকন মিয়ার কাছে এই কর্ম পরীক্ষিত। কিন্তু আজ কয়েকবার খোঁজার পরেও মাছি মারার হাতিয়ার সে খুঁজে পেল না। এদিকে ঘুমের জন্য খোকন চোখ মেলতে পারছে না। অগত্যা মশারি উঁচু করে কয়েকবার ঝাড়া শুরু করল। ঘুম চোখে দু-তিনবার মশারি ওঠানামা করে মাছি মুক্তির আশায় আবার শুয়ে পড়লো নব্য উস্তাদ। সবে মাত্র চোখ দুটো লেগে এসেছিল এমন সময় টিনের চালের উপরে দুটো বিড়ালের তুমুল ঝগড়া ও মারামারিতে আবার ঘুম ভাঙলো খোকনমিয়ার।
গায়ের লেপটা জড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে শুতে যেতেই ছোট ছেলের কান্নার শব্দে ঘুম চটে গেল। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। খোকন কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করল। রুপন জানালো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা রংয়ের প্রাইভেট গাড়িটার সাইলেন্সারে আপন একটি গোল আলু ভরে দিয়েছিল। সেই কর্ম দেখে ফেলে গাড়ির মালিক। আপন কে ধরতে ধমক দিলে সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। হাতের কাছে রুপম কে গাড়ির মালিক পেয়ে এই কাজে সহযোগিতার অপরাধে তার দুই গাল লাল করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে খোকন কার বিচার করবে সেই উভয় সংকটে ছোট ছেলেকে কান ধরে ধমক দিয়ে বলল বড়ডা কই?
২
ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ৫ টন ট্রাকটি সামনে এগিয়ে নিচ্ছে খোকন মিয়া। সামান্য দূরের জিনিসও স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে না। হেল্পার মজিদ নিজের গামছা দিয়ে কয়েক দফা গাড়ির গ্লাস মুছে দিয়েছে।
বিপরীত প্রান্ত থেকে আসা অন্য গাড়ির ফগ লাইট হঠাৎ হঠাৎ চোখে লাগছে খোকনমিয়ার। বুকের ভিতর আচমকা কামড় দিয়ে কয়েকবার জায়গায় ব্রেক করেছে সে। ডান পাশের ছোট জানলা দিয়ে মাথা বের করে অন্য ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে জঘন্য কিছু খিস্তি দিয়েছে সে। গাড়ির সিটে বসে খিস্তি দেওয়ার রীতি বহুবছর ধরে প্রচলিত রয়েছে। যে যত বিকট গলায় খিস্তি দিতে পারবে সে তত অভিজ্ঞ ড্রাইভার হিসেবে পরিণত হবে এমনটাই বিদ্যমান রয়েছে অনেকের মনে।
দুই প্রান্ত থেকেই কিছু সময় অসভ্য বাক্য বিনিময়ের পথ আবার ক্লাশে পা রাখে খোকন। ইট বোঝাই ট্রাক আবার মাটি কাঁপিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে।
আজ মহাজনের কড়া কথা শুনতে হয়েছে খোকনকে। ফোন দিয়ে তাকে না পেলে এবং সময় মতন ট্রিপ ধরতে না পারলে মহাজনের চড়া কথা শুনতেই হয়। অন্যদের দেখাদেখি নিজের শখ পূরণের জন্য একটা টাচ মোবাইল ফোন কিনেছে খোকন মিয়া। কেনার পর থেকে এখনো নিজের কাছে পুরো একটা দিন রাখতে পারিনি ফোনটি। দুই ছেলে বিভিন্ন কৌশলে ফোনটিকে নিয়ে গেমস খেলায় মত্ত হয়ে যায়। নিজেদের খেলার সময় যত গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসুক না কেন তা তাদের কাছে সম্পূর্ণ বিরক্তিকর। কল কেটে দিয়েই আবার দুই ভাই ব্যস্ত হয় গোলাগুলিতে। দুপুরেও মহাজন কয়েকবার ফোন দিয়ে আজকের বাড়তি ট্রিপের কথা জানাতে না পেরেই ফুসে ছিলেন।
সন্ধ্যার পর খোকনকে সামনে পেয়ে বুকের ভিতর জমা কথাগুলো ক্ষোভের সাথে বের হয়ে আসলো। জমিদারের ব্যাটা ফোন ধরস না কেন? কাম কাজ বাদ দিয়া বউ নিয়ে বাড়িতে বইসা ফুর্তি করতাছিলি। তোর লাইগা আমার একটা ট্রিপমিস হইল। আরো অনেক কিছু বলেছিল যা পাঠক শ্রেণীর শোনার অযোগ্য। আজকেই তোরে শেষবারের মতন কইলাম এরপরে যদি কোনদিন আমার ফোন তুই না ধরোস তাইলে আর ট্রাকেও উঠার সুযোগ পাবি না। পুটকিতে লাথি দিয়া ট্রাকের থেকে নামায় দিমু। আমার নাম রসু মহাজন। আমি এক কথার মানুষ। কথার বরখেলাপ করা আবার বংশে নাই।
নিরবে সব কথা খোকন মিয়া সহ্য করে মনে মনে ছেলেদের উপরে খুব রেগে রইলো। ছেলেদের কর্মের জন্যই তাকে এতগুলো কথা শুনতে হল। খিটখিটে মেজাজ স্টিয়ারিংয়ে বসে খিস্তি দিয়ে মজিদকে ডেকে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিল সে।
কুয়াশার জন্য পিপড়ার গতিতে চলছে ট্রাক। মজিদ দু দফা ওস্তাদকে গান ছাড়ার কথা বলেছিল। খোকন হ্যাঁ না কিছুই জানায়নি, মজিদের আর সাহস হচ্ছে না আরেকবার গান ছাড়ার কথা বলার জন্য। মজিদ এখন খালাসী, গাড়ি ধোয়া থেকে শুরু করে মোছা বা গাড়ি পেছনে নেওয়ার সময় সিগনাল দেওয়াই তার কাজ। ওস্তাদের ফাই ফার্মাস খেটে দ্রুত ড্রাইভার হয়া তার স্বপ্ন। ওস্তাদকে তাই অকারনে সে চটাতে চায় না। মজিদ এখনো বিয়ে করে নাই। উঠতি বয়স। গাড়িতে উঠলে তার গান শুনতে ইচ্ছা করে। হিন্দি হোক বা বাংলা, যেকোনো গানেই তার আগ্রহ চোখে পড়ার মতন।
খোকনমিয়ার দু’চোখ ঘুমে ভেঙ্গে যাচ্ছে। আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসছে চোখের পাঁতা। সারাদিন সে ঘুমাতে পারেনি। গাড়ি চালতে পারলে হয়ত তার ঘুম আসতো না। কিন্তু জ্যামের কারণে ট্রাক অনেকক্ষণ স্থীর হয়ে একস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। চাইলে সে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারে। কিন্তু স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে মাথা নতো করতেই পিছন থেকে গাড়ির হর্ন দিয়ে তাকে ডেকে দিচ্ছে। সামনের গাড়ি এক ইঞ্চি এগোলে তাকেও সেই এক ইঞ্চির শূন্যস্থান পূরণ করতে হচ্ছে। সন্ধ্যার থেকে খোকনমিয়ার গলা বুক জ্বলছে। বউয়ের রান্না করা তরকারিতে আজ ঝালের পরিমাণটা একটু বেশিই হয়েছে। খোকন মিয়া তরকারিতে ঝাল মোটেই সহ্য করতে পারে না। বাড়তি ঝালের কারণেই এখন তার এই অস্বস্তি। গাড়ির ডেকে থাকা পানির বোতল থেকে কয়েক দফা সে পানি পান করেছে। তবু কিছুতেই তার গলা বুক জ্বলা কমছে না।
গম্ভীর গলায় খোকন মজিদের কাছে জানতে চায় কতদূর পর্যন্ত জ্যাম আছে বলে তার মনে হয়? মজিদ কুয়াশা গভীরতা ভেদ করতে না পেরে চুপচাপ সিটে বসে মাথা চুলকাতে থাকে। বিপরীত প্রান্ত থেকে একের পর এক সব ডিস্ট্রিক্ট বাস পার হয়ে যাচ্ছে। মুরগি বোঝাই একটা পিকআপ ভ্যানকে আসতে দেখে মজিদ জিজ্ঞাসা করল কত দূর পর্যন্ত এই জ্যাম লেগে আছে। ড্রাইভার হালকা স্লো করে জানান দিল করিমগঞ্জ পর্যন্ত এই জাম লেগে আছে। এদিকে পিকাপে থাকা মুরগির গন্ধে খোকনমিয়ার পেট গুলিয়ে এলো। সে এই গন্ধ হজম করতে পারল না। নিজের ডানপাশের জানলা দিয়ে মাথা বের করে ওয়াক করতেই বমি হয়ে পেটের ঝাল যুক্ত তরকারি পুনরায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
মজিদ অবাক হয়ে হাতের কাছে থাকা পানির বোতল দ্রুত এগিয়ে দেয় খোকন মিয়ার দিকে। ওস্তাদের সাথে যতদিন সে গাড়িতে আছে কোনদিন সে খোকন মিয়া কে বমি করতে দেখেনি। এমনকি গাড়ির ড্রাইভাররা বমি করতে পারে এটাই মজিদ মিয়ার জানা ছিল না। অবাক কণ্ঠে মজিদ বলল ওস্তাদ সব ঠিক আছে তো? ভাটিতে ইট উঠানোর সময় আপনি একটা চিতই পিঠা খাইছিলেন। তখন পাশে বইসা থাকা ফরিদ বারে বারে আপনার পিঠা খাওয়া দেখতেছিল। আমার মনে হয় তার কু নজন লাগছে। না হইলে আপনি মানে খোকন ওস্তাদ গাড়ির স্টারিংয়ে বইসা বমি করবো এটাও বিশ্বাস করা যায়।
বুকের জ্বালাপোড়া টা অনেক কমে গেছে খোকন মিয়ার। সেই সঙ্গে চোখ থেকে ঘুমটা উড়ে গেছে। সামনের গাড়িটা বেশ লম্বা টান দিয়েছে। খোকন মিয়ার গলায় ঝুলে থাকা মাফলারে মুখ মুছে একের পর এক গিয়ার পরিবর্তন করতে লাগলো।
৩
গাড়ি আবার অনেকক্ষণ হলো জ্যামে আটকে আছে। খোকন মিয়া জামশেদ নামে এক ড্রাইভার এর কাছে বেশ কিছু টাকা পাবে। তারা দুজনেই একই লাইনে গাড়ি চালায়। সুযোগ পেলেই জমশেদ দৌলতদিয়ার রাত পরীদের অতিথি হয়। এই বদ অভ্যাসের কারণে খোকন মিয়া জমশেদকে মোটেই সহ্য করতে পারে না। খোকন মিয়ার বউ বদ মেজাজি ও কর্কশ কণ্ঠের হলেও কোন মেয়ে কোনকালেই খোকন মেয়েকে আকর্ষিত করতে পারেনি। পরের পাতে মুখ দেওয়ার বাজে মানসিকতা তার নেই। খোকন মিয়ার কাছে কেউ টাকা চাইলে থাকতে সে কাউকে না করতে পারে না। এর ধারাবাহিকতায় জমশেদ সে না করতে পারেনি। মাসের শেষভাগ খোকন মিয়ার হাতের অবস্থাও খুব বেশি ভালো না তাই সে আজ দুদিন হল জমসেদকে ফোনে ট্রাই করছে। কিন্তু জমশেদ কিছুতেই খোকনের ফোন ধরছে না।
আরো বিরক্তির বিষয় এই যে জমশেদ তার ফোনে ডুয়েল মিনিং একটি অশ্লীল গান কলার টিউন হিসেবে সেট করে রেখেছে। গানটি আবার কুখ্যাত শিল্পীর বিখ্যাত গান। যতবারই জমসেদ কে ফোন দেয়া হয় ততবারই অনিচ্ছায় খোকন মিয়ার এই গান শুনতে হচ্ছে। জামশেদকে ফোন দেওয়ার দায়িত্বটা এখন পালন করছে মজিদ। খোকন বলেছে তোর কাজ এই সিটে বসে গাড়ি না থামা পর্যন্ত জামসেদ কে ফোন দিবি। কেউ ফোন না ধরলে তাকে বারেবারে ফোন দেওয়ার ভিতরেও একটা মজা আছে। খোকন মিয়ার বিনোদন স্বল্প জীবনে জমসেদ কে ফোন দিয়ে বিরক্ত করতে পেরে ক্ষণিকের বিনোদন নিতে পারছে। এটাই তার কাছে টাকা উসুলের সমান তৃপ্তি। খোকন মিয়া বুঝে গেছে জামশেদ ইচ্ছা করেই তার ফোন ধরছে না।
দুপুরে বাড়িতে গোসল করার সময় খোকন মিয়া সব সময় ছেলেদের ডেকে তাদের গোসল করিয়ে নিজে গোসল করে। আজ দুপুর বেলা ছোট ছেলেকে পাওয়া গেলেও বড় ছেলেকে পাওয়া যায়নি। মোড়ের মাথার একটা দোকানে ওয়াইফাই আছে। খোকন মিয়ার ফোনে সেই পাসওয়ার্ড লগইন করা। বড় ছেলে ফোন হাতে পেলেই সেই দোকানের আশেপাশে বসে অনলাইনে গেমস খেলে। গেমসের নেশায় নাওয়া খাওয়ার কোন খবর তার থাকে না। খোকন মিয়া ছোট ছেলেকে খুব ভালোবাসে। ছোট ছেলেটাও বাপের নেড়ু। সব সময় বাপের সাথে সাথে থাকে।
বাপের নেশায় না ফোনের নেশায় বাপের পিছু পিছু ছোট ছেলে লেগে থাকে। আর সুযোগ বুঝে বাপের কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নিয়ে দোকানের হাবিজাবি খায়। ছোট ছেলেকে গোসল করিয়ে বড় ছেলের খোঁজে পাঠিয়ে দেয় খোকন মিয়া। আজকের গোসলটি মনের মতন হলো না তার। গায়ে ডলার সাবান ছিলনা। ধুলাবালির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে আসার পর সাবান দিয়ে ঢলে গোসল না করলে খোকন মিয়ার মনে তৃপ্তি আসে না। গত পরশুদিনই নতুন একটা সাবান আনা হয়েছিল। দুপুর বেলা ধারের কাছের দোকানগুলো সব বন্ধ থাকায় নিহাত পানি ঢেলেই গোসল সেরে নাই সে। অনেক সময় কেটে গেলেও ছোট ছেলেরও আশার নাম নাই দেখে তাদের খোঁজে বের হয় নব্য ওস্তাদ। খিদে পেটে দুই ছেলেকে অনেক খুঁজেও না পেয়ে হতাশ হয়েই ঘরে ফিরে আসে সে। দুই ছেলেকে ছাড়া খেতে বসার ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু পেটের খিদের কাছে আবেক চলে না।
পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার অনেকক্ষণ ধরে ডিপার আলো অন অফ করে ওভারটেকিং এর জন্য সংকেত দিচ্ছে। বিরক্ত হয়েই কখন খোকন মিয়া গাড়ির সাইড দিয়ে দেয়। শা করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় কালো রঙের প্রাইভেটকার।
মজিদ বলে উঠলো ওস্তাদ ফোন ধরছে। খোকন ফোনটি লাউডস্পিকারে দিতে বলল। অপরপ্রান্ত থেকে একটা অপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো। চাবানো চাবানো কন্ঠে সে উত্তর দিল এই মুহূর্তে জমশেদ ওস্তাদ এখানে নেই। ফোনটি তার কাছে দিয়ে গেছে। কোন দরকার থাকলে আমাকে বলেন। ওস্তাদ আসলে তাকে বলে দেব। খোকন বুঝে গেল এটাও জমশেদের একটা চাল। ইচ্ছা করে ফোন না ধরার অজুহাত। খোকন আর কোন কথা না বলে ফোনটি কেটে দিতে বলল।
জ্যাম শেষ হওয়ার পরে সকল ড্রাইভারের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। রাস্তায় আটকে থাকার সময়টুকু জোরে চালিয়ে পুষিয়ে নিতে চায় সবাই। ঢাকা আরিচা সড়কে খোকনের ট্রাক ছুটে চলেছে। মিটারের জানান দিচ্ছে গাড়ির গতি ৯০ কিলোমিটার।
দুপুরে খোকন একটু ঘুমাতে পারেনি। দুই ছেলের খোঁজে বের হয়েছিল। রাতের গাড়ি চালানোর সময় চোখে ঘুম আসলে মহাবিপদ। খোকনের চোখে ঘুম না আসলেও শরীর খুব দুর্বল লাগছে। এই ট্রিপ শেষ হয়ে গেলে খোকন মিয়া আজ আর কোন ট্রিপ মারবে না বলে মনে মনে ভাবে।
৪
গাড়ি আশুলিয়ার কাছে আসতেই নতুন এক বিপত্তি পড়েছে খোকনমিয়ার ট্রাক। পিছনের একটি চাকা পাংচার হয়ে গেছে। চাকা খোলার জগ গাড়িতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেজাজ অত্যন্ত খিটখিটে হয়ে আছে খোকন মিয়ার।
মজিদ দু দফা ওস্তাদের কাছে গালি খেয়েছে। কিন্তু গালি খাওয়ার মতন কোন অপরাধ তার ছিল না। খোকন গাড়ির মহাজন রসুকে বার কয়েক ফোন দিয়েও পাইনি। রাতে গাড়ি বাইরে থাকলে রসু মহাজন সাধারণত ফোন না ধরে থাকে না। আজ তার ব্যতিক্রম। সম্ভবত পন্ডিত পাড়ার বাউল গানের আসরে গান শুনতে গেছেন তিনি। গানের শব্দের কারণে ফোনের শব্দ বুঝতে পারছেন না।
এদিকে জগ ম্যানেজ করতে না পারলে গাড়ির চাকা খোলা সম্ভব হবে না। ২ ইঞ্চি একটা নাট টায়ার ভেদ করে গাড়ির চাকা ফুটো করে দিয়েছে। ড্রাইভার জীবনে এসব ঝুট ঝামেলা মানিয়েই চলতে হয়, ছাত্র অবস্থায় তার ওস্তাদের কাছ থেকে এমনটাই শিখেছিল খোকন মিয়া। একে তার শরীর ভালো না তার উপরে অঘুম চোখ। এই দুয়ের প্রভাবেই নিজের মাথা ঠিক মতন কাজ করছে না। ট্রাকের চাকা খোলার বড় লোহার পাইপটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মজিদ। এই পাইপের উপরে দাঁড়িয়ে বিশেষ কায়দায় চাপ দিয়ে ট্রাকের চাকা খুলতে হয়। বিষয়টা মজিদের কাছে খুব ভালো লাগে।
ট্রাক ভর্তি ইট না থাকলে অন্য চাকাটির সাহায্য নিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু গাড়ি ওভারলোড হওয়াতে খোকন মিয়া এই পথে পা বাড়ালো না।
এদিকে রাস্তার যে পাশে গাড়ি সাইড করে রাখা হয়েছে তাতেও পিছন থেকে আসা গাড়ির বেশ সমস্যায় হচ্ছে। মজিদ গাছের কয়েকটি ডালপালা ও একটি লাল রঙের কাপড় যোগাড় করে গাড়ির পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে। যাতে অন্যরা সাবধান হতে পারে। সড়ক পুলিশ দ্রুত গাড়ি সরানোর হুশিয়ারি দিয়ে গেছে। বেশি দেরি হলে গাড়ির রেকার করা হবে হুমকি দিয়ে গেছে। উভয় সংকটে পড়েছে খোকন মিয়া। শীতের রাতে কুয়াশার ভেতর গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার মোটেই ভালো লাগছে না। মজিদ আশেপাশে জগ খোঁজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। একেই কুয়াশার চাদর ভেদ করা রাত। তার উপরে মহাসড়ক। সাই সাই করে পাশ কাটিয়ে অন্য গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে।
খোকনমিয়ার এই অসহায় অবস্থাত ছেলেদের কথা মনে পড়ছে। দুপুরে বেশ কড়া করেই দু ছেলেকে মেরেছে সে। হাতে মোবাইল পেলে আর আশেপাশের কোন খোঁজ থাকে না দুই ছেলের। বিবেক আর আবেগ সবসময় ঠিক থাকার কাজ করে না। মাথায় হঠাৎ রাগ উঠে যাওয়া খোকন মিয়ার। এটা একটা মানসিক রোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করে অতিরিক্ত রাগ উঠে যাওয়ার কারণ নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছে খোকন মিয়া। ডাক্তার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে মানসিক চাপ ও ঘুম কম হয় এর প্রধান কারণ।
মহাজন ফোন করেছে। তিনি জানিয়েছেন সন্ধ্যায় ভুলবশত এই গাড়ির জ্যাক অন্য গাড়িতে চলে গেছে। এখন আর কোন উপায় না থাকলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছে। অথবা মজিদকে দু কিলোমিটার সামনে মার্জুর গ্যারেজে গিয়ে জ্যাকচ নিয়ে আসতে বলেছে। মহাজনের সাথে রাগ দেখানো চলে না। নীরবে তার সব কথা শুনে আচ্ছা বলে ফোন কেটে দিল খোকন মিয়া।
খোকন মিয়া গাড়ির ভেতরের দরজা আটকে বসে আছে। আর মজিদ গেছে জ্যাকের ব্যবস্থা করতে। খোকন মিয়ার একটা ফ্রিজ কিনার শখ বহুদিনের। আস্তে আস্তে করে টাকা জমাচ্ছে সে ফ্রিজ কিনবে বলে। এক সেট সোপাও কিনা তার খুব ইচ্ছা। খুবই গরীব ঘরে বড় হয়েছে সে। অভাব অনটনের মধ্যে দিন পার করে আজকের এ পর্যায়ে এসেছে সে। কি রংয়ের ফ্রিজ কিনবে ভাবতে ভাবতে চোখে নিদ্রা চলে এলো খোকনমিয়ার। গাড়ির স্টারিংয়ে মাথা রেখে সময়টা কাজে লাগাতে চাইল খোকন মিয়া।
ঘুমের ভিতর যখন সে হরেক রকম স্বপ্ন দেখায় ব্যস্ত। ঠিক তখনই আচমকা বিরাট ঝাকিতে তার চেতন ফেরে। পেছন থেকে একটি ডিস্ট্রিক্ট বাস তার ট্রাকে সজোরে ধাক্কা মেরেছে। খোকন মিয়া চোখ খুলেও চোখে সে অন্ধকার দেখছে। কপাল বেয়ে স্রোতের মতন রক্ত ঝরছে। কানে হর্নের ভো ভো শব্দে তার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। পেছনের গাড়ি থেকে যাত্রীদের আত্মচিৎকার আর কান্নাকাটির শব্দ ভেসে আসছে। খোকন মিয়া দুচোখ খোলার অনেক চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারল না।
আস্তে আস্তে চারপাশের সব শব্দ কমে যাচ্ছে। নিস্তেজ শরীরটা নেতিয়ে পড়ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে দুই ছেলের মুখ। খোকন মিয়ার কল্পনার চোখে ভেসে উঠলো কয়েকটি প্রজাপতি। যারা মাঠ ভরে উড়ে বেড়াচ্ছে। খোকন মিয়া ও তার দুই ছেলে সেই প্রজাপতি গুলোর পিছন পিছন ছুটে চলেছে। দূরে বউ কর্কশ গলায় তাদের ডাকছে। সেই ডাক খোকন মিয়ার কাছে বিরক্তির মতন লাগলো। ছেলেদের নিয়ে সে আরো দ্রুত প্রজাপতির পিছনে ছুটতে শুরু করল।
গল্পের গল্প।। দু তিন কিস্তিতে গল্পটি লেখা শেষ করলাম। মাঝে গ্যাপ হয়েছে তিন মাস। ৮ জুন ২০২৫ শুক্লা বাপের বাড়ি গেছে। আমি বাসায় একা। এরই মাঝে গল্পটি আবার শুরু থেকে পড়ে শেষ অংশটুকুন লিখে ফেললাম। কাকতালীয় ব্যাপার আমার বাসার পাশে সত্যিই একজন খোকন নামের ড্রাইভার আছে।
গল্পের অনেক ঘটনাই তার জীবনের থেকে অনুপ্রাণিত।- রাহুল রাজ।