• আজ ১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

“জলবায়ুর ছোবলে বিপন্ন গ্রাম: দায়িত্বহীনতা না পরিবর্তনের ডাক?”

| নিউজ রুম এডিটর ১২:২২ পূর্বাহ্ণ | জুন ১, ২০২৫ ফিচার

 

মো: সাইফুল্লাহ খাঁন, (সাংবাদিক ও কলামিস্ট) :

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি নিম্নভূমির দেশ, যার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য একদিকে যেমন কৃষিনির্ভর ও নদীমাতৃক, অন্যদিকে তেমনি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবছর নিয়মিত বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের গ্রামীণ জনপদ। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের এই দুর্যোগ পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। অথচ এই সকল বিপর্যয়ের মুখে সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলো।

এই দীর্ঘ ফিচারে আলোচনা করা হবে—বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা, গ্রামীণ জনপদের সামাজিক-অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সরকারের ভূমিকা ও ঘাটতি, মানবাধিকার সংগঠনের দায়িত্ব, এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের করণীয়।

বাংলাদেশের জলবায়ু ও বন্যা পরিস্থিতি: বাস্তবচিত্র :

বাংলাদেশ প্রতিবছরই কোন না কোন অংশে বন্যার সম্মুখীন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যার ভয়াবহতা অতীতের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিবৃষ্টির ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়। প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ বিপর্যস্ত হয়, এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ শিশু ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্ষাকালে অনিয়মিত ও তীব্র বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা আকস্মিক বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা প্রবেশ এই বাস্তুচ্যুতির বড় কারণ।

গ্রামীণ জনপদের সংকট: নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও দারিদ্র্য

গ্রামীণ জনপদে বসবাসকারী মানুষদের জন্য জলবায়ু সংকট শুধুই প্রকৃতির রোষানলে পড়া নয়, বরং এটি একটি জীবন-মরণ সংকট। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল যেমন—বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী ও ভোলা এলাকায় নদীভাঙন এবং লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে কৃষি ও মৎস্যচাষে ধ্বংস ডেকে এনেছে। এর ফলে স্থানীয় মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, আয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।

অনেক অঞ্চলে পানযোগ্য জল নেই, কারণ পুকুর ও নলকূপগুলো লবণাক্ততায় আক্রান্ত। চাষযোগ্য জমি অকেজো হয়ে যাচ্ছে, এমনকি গৃহপালিত পশুও নিরাপদ খাবার পাচ্ছে না।

সরকারের দায়িত্ব ও উদ্যোগ: কতটা কার্যকর?

সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেমন—নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টার বৃদ্ধি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি, ও আগাম সতর্কবার্তা প্রদান। তবে বাস্তবতা হলো, এই উদ্যোগগুলো অনেক সময়ই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ঘাটতিতে ভোগে।

যেখানে বন্যা প্রতিরোধে প্রকৃত পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেখানে অনেক সময় রাজনৈতিক দুর্নীতি, প্রকল্পের ধীরগতি, এবং জনসম্পৃক্ততার অভাব প্রকৃত পরিবর্তনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া নদীভাঙন রোধে জরুরি নদী ড্রেজিং বা পাড় সংরক্ষণ প্রকল্প অনেক এলাকাতেই দৃশ্যমান নয়।

মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠনের ভূমিকা :

জলবায়ু ন্যায়ের কথা বলতে গেলে এনজিও ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইউনিসেফ, ব্র্যাক, উত্তরণ, আশ্রয়, অক্সফাম-এর মতো সংস্থা জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো, দুর্যোগ প্রশমন, নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষার পুনরুদ্ধার প্রভৃতি কাজ করে যাচ্ছে। তবে জনসংখ্যার তুলনায় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত।

এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠনগুলো সচেতনতামূলক কাজ করলেও তাদের হাতে নেই প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রশাসনিক ক্ষমতা। তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবে তারা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে না।

সম্ভাব্য প্রতিকার ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় :

১. জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ

সাইক্লোন শেল্টার ও বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ স্থায়ীভাবে নির্মাণ

নদীভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ এবং জিওব্যাগ ব্যবহার

২. পরিবেশবান্ধব কৃষি ও প্রযুক্তির ব্যবহার

লবণাক্ততা সহনশীল ধান, শাকসবজি, এবং মাছের জাত উদ্ভাবন

অর্গানিক কৃষি ও জলাশয় ব্যবস্থাপনা

৩. সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার

গ্রামীণ এলাকায় জলবায়ু শিক্ষার প্রচলন

জলবায়ু সহনশীলতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণশিবির

৪. সরকার-এনজিও যৌথ উদ্যোগ

সরকারি প্রকল্পে স্থানীয় সংগঠনের সম্পৃক্ততা

দুর্যোগপূর্ব ও পরবর্তী সময়ে এনজিওদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ

৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

উন্নত দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে অর্থায়ন বৃদ্ধি

জলবায়ু ক্ষতিপূরণ তহবিল দ্রুত বাস্তবায়ন :

জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর দূরের কোনো ভয়াবহতা নয়, এটি আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে এই বাস্তবতা প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বন্যা, লবণাক্ততা, নদীভাঙন শুধুমাত্র প্রকৃতির খেলা নয়, বরং আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশও বটে।

সরকার, বেসরকারি সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ—সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই কেবল এই জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন এবং জলবায়ু ন্যায়ের ভিত্তিতে সকল মানুষের টেকসই জীবনের নিশ্চয়তা।