• আজ ৯ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবায় অকুপেশনাল থেরাপি – আমিনা রহমান

| নিউজ রুম এডিটর ১০:০১ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ২৫, ২০২৫ স্বাস্থ্য

অকুপেশনাল থেরাপি এমন একটি বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী উভয় ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মে পুনরায় সক্ষম, স্বনির্ভর ও অর্থবহভাবে যুক্ত হতে সহায়তা করে। রোগ, দুর্ঘটনা, মানসিক চাপ বা জন্মগত প্রতিবন্ধকতা—যে কারণেই হোক, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারানো মানুষকে এই চিকিৎসার মাধ্যমে আবার নতুনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব।

২৭ অক্টোবর বিশ্ব অকুপেশনাল থেরাপি দিবস, এইবারের প্রতিপাদ্য বিষয় “অকুপেশনাল থেরাপি ইন একশন” — এই বার্তাটিই দেয় যে অকুপেশনাল থেরাপি কেবল থেরাপি রুমে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজ, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এবং প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটি স্তরে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশে অকুপেশনাল থেরাপির যাত্রা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে। সে বছর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন–এর অধীনে প্রথম অকুপেশনাল থেরাপি কোর্স চালু হয়, যা দেশের পুনর্বাসন সেবার নতুন যুগের সূচনা করে।
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনস ইনস্টিটিউট (বিএইচপিআই) এ ব্যাচেলর অব অকুপেশনাল থেরাপি কোর্স চালু হয়। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আরও তিনটি নতুন প্রতিষ্ঠান অকুপেশনাল থেরাপি শিক্ষা শুরু করে।
আজ পর্যন্ত মোট ৪৯৬ জন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত হয়েছেন, যারা পুনর্বাসন সেবায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।

তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন, কিন্তু তাদের সেবায় কর্মরত অকুপেশনাল থেরাপিস্টের সংখ্যা মাত্র ৪৯৬ জন। অর্থাৎ, প্রতি ৩২,০০০ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট কাজ করছেন — যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অতি অপর্যাপ্ত।
এই চিত্রটি দেখায় যে দেশে পেশাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কত দ্রুত নতুন প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন।

অকুপেশনাল থেরাপির কাজের ক্ষেত্রসমূহ:
শিশুদের উন্নয়নে: অটিজম এবং অন্যান্য নিউরো ডেভেলপমেন্টাল সমস্যাযুক্ত শিশুদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে অংশগ্রহণের সক্ষমতা বাড়াতে অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা কাজ করছেন—যেখানে খেলার মাধ্যমে শেখানো, মোটর দক্ষতা উন্নয়ন এবং আত্মনির্ভরতা তৈরিই মূল লক্ষ্য।

শারীরিক পুনর্বাসনে: সড়ক দুর্ঘটনা বা স্ট্রোকের ফলে কর্মক্ষমতা হারানো রোগীদের থেরাপির মাধ্যমে আবারও পূর্বের দৈনন্দিন জীবনের কাজ যেমন: পোশাক পরা, রান্না করা কিংবা পেশায় ফিরে যাওয়ার সক্ষমতা ফিরিয়ে আনা হয়।

মানসিক স্বাস্থ্যে: বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ট্রমা বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগা মানুষদের জন্য কার্যভিত্তিক থেরাপি আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনে।

কর্মক্ষেত্র ও সমাজে: কর্মস্থলের আরগোনমিক ডিজাইন, কর্মজীবীদের বার্নআউট প্রতিরোধ, এবং বয়স্কদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান নকশায়ও কাজ করছেন।

জেরিয়াট্রিক্স বা বয়স্কদের যত্নে: বয়স্কদের ক্ষেত্রে পড়ে যাওয়া রোধ, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া), আলঝাইমার ইত্যাদি সমস্যায় কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে ও নিরাপদভাবে দৈনন্দিন কাজ করতে সাহায্য করেন।

কমিউনিটি ও সমাজভিত্তিক সেবায়: গ্রামীণ বা শহরাঞ্চলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে কাজ করেন।
সহায়ক প্রযুক্তি ও অ্যাডাপটিভ যন্ত্রপাতি: রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী হুইলচেয়ার, স্প্লিন্ট, অ্যাডাপটিভ কিচেন টুলস, কম্পিউটার অ্যাকসেস ডিভাইস ইত্যাদি তৈরি বা পরামর্শ দেন, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন।

গবেষণা ও শিক্ষা: অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণার মাধ্যমে পেশার উন্নয়নে অবদান রাখেন।
গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় থেরাপি সেবা পৌঁছে দেওয়া বাংলাদেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কম ব্যয়ে মোবাইল থেরাপি ইউনিট, স্কুলভিত্তিক পুনর্বাসন প্রোগ্রাম এবং কমিউনিটি ভলান্টিয়ার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এছাড়া সরকারি হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট নিয়োগ এবং জাতীয় নীতিমালায় এই পেশাকে আরও সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

বিশ্ব অকুপেশনাল থেরাপি দিবস ২০২৫ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় — “অকুপেশনাল থেরাপি ইন একশন” মানে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থবহ জীবনযাপন নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে এই পেশার আলোকচ্ছটা পৌঁছে দিতে এখনই সময় সচেতনতা ও উদ্যোগের।

লেখক: লেকচারার, অকুপেশনাল থেরাপি ডিপার্টমেন্ট
বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশন ইনস্টিটিউট (বিএইচপিআই)
একাডেমিক ইনস্টিটিউট অফ সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি), সাভার।