করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি মানুষ। রয়ে গেছে হাসপাতাল, প্রাণহানি, হরেক বিধিনিষেধ ও ঘরবন্দি থাকার মতো মর্মান্তিক সব ঘটনার রেশ। আতঙ্ক থেকে সামান্য ফুরসত পেতে যাচ্ছিল বিশ্ব। এরইমধ্যে আরেক দুঃসংবাদ নিয়ে এল বিরল রোগ মাঙ্কিপক্স।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, এগারোটি দেশে ৯০ জনের বেশি ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এছাড়া আরও ২৮ সন্দেহভাজন রোগী পাওয়া গেছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ শার্লট হ্যামার বলেন, সংক্রমণ থেমে নেই। আমরা নতুন আক্রান্ত দেখতে যাচ্ছি।
তিনি জানান, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সক্রিয়ভাবে রোগী শনাক্ত করছে। এতে যারা হালকা আক্রান্ত, তাদেরও শনাক্ত করা যাবে। এক থেকে তিন সপ্তাহের একটি সুপ্তাবস্থা থাকে মাঙ্কিপক্সের। প্রথমে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সংস্পর্শে আসারাও এতে সংক্রমিত হবেন। সংক্রমণ বাড়বে।-খবর বিবিসি ও গার্ডিয়ানের।
বিশ্বজুড়ে রোগটির আক্রান্তের সংখ্যা নজিরবিহীন। এটি সাধারণত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাভিত্তিক ভাইরাস। অর্থাৎ মাঙ্কিপক্স একটি স্থানীয় রোগ। কিন্তু একই সময়ে ভিন্ন মহাদেশে এতগুলো মানুষের আক্রান্তে চিকিৎসকেরাও ধাঁধায় পড়েছেন।
রোগটির উৎস
করোনা মহামারির মধ্যেই কী বড় হতাশা নিয়ে আসবে রোগটি, নাকি গুরুত্ব না-দিয়ে অগ্রাহ্য করে যাবেন? সত্যি বলতে এটি করোনার মতো কোনো ভাইরাস না। আবার বলা চলে, মাঙ্কিপক্সের প্রকোপরোধে লকডাউন আরোপ হওয়া থেকে খুব বেশি দূরেও না। প্রাদুর্ভাব বড় আকার নিলে লোকডাউন ঘোষণা হতে পারে।
এ সময়ে এসে রোগটি নিয়ে খুব বেশি ভবিষ্যদ্বাণী করা যাচ্ছে না। ভাইরাসটির প্রাকৃতিক উৎস বন্যপ্রাণি। নাম দেখে রোগের বাহক বানর মনে হলেও রোডেন্ট জাতীয় প্রাণিই এটিকে বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছে।
রোডেন্ট হলো তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণি। ইঁদুর জাতীয় স্তন্যপায়ীদের একটি গোষ্ঠী, বিশেষ করে খরগোশ, কাঠবিড়ালী ও সজারুসহ আরও অনেক । অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া অন্য সব মহাদেশে এদের দেখা মেলে।
পশ্চিম আফ্রিকার চিরহরিৎ বনাঞ্চলে বাস করা ও মধ্য আফ্রিকার কেউ কেউ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। সংক্রমিত প্রাণির সংস্পর্শে এসেছিল তারা। এভাবেই বুনো প্রাণি থেকে মানবদেহে চলে আসে ভাইরাসটি। সচরাচর বসতি থেকে বেরিয়ে তা মানুষের শরীরে আশ্রয় খুঁজে পায়।
এরআগে যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট প্রকোপ দেখা দিয়েছিল মাঙ্কিপক্সের। তখন আক্রান্ত-দেশ ভ্রমণ করে নিজ দেশে ভাইরাসটি নিয়ে আসে তারা।
এই প্রথম ভাইরাসটি এমন সব মানুষের শরীরে পাওয়া গেল, তাদের সঙ্গে পশ্চিম কিংবা মধ্য আফ্রিকার কোনো যোগসাজশ নেই। এমনকি তাদের আক্রান্তের উৎসও পাওয়া যায়নি। কাদের মাধ্যমে তাদের শরীরে ছড়িয়েছে, তা অস্পষ্ট রয়ে গেল।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যার পিটার হোরবি বলেন, আমরা নতুন এক পরিস্থিতিতে পড়েছি। এতে সবাই যেমন অবাক হয়েছেন, তেমনই বিস্মীত। তবে এটি কোনো দ্বিতীয় করোনা হতে যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ভাইরাসটি প্রতিরোধে আমাদের কাজ করতে হবে। এটি স্থায়ী হওয়া প্রতিরোধে পদক্ষেপ দরকার। এতে ঝুট-ঝামেলায় না-জড়িয়ে মসৃণভাবে রোগটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন মাঙ্কিপক্স রোগীর চিকিৎসার অভিজ্ঞতা থাকা ডা. হিউগ অ্যালডার।
উপসর্গ ও অসুস্থতা
যৌন সম্পর্কসহ পারস্পরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে এটি ছড়ায়। দীর্ঘ সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা প্রাণির কাছাকাছি থাকলে সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা থাকছে। এছাড়া রোগীর বিছানাপত্র ও শয্যা ব্যবহার করলে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।
আক্রান্ত হলে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ফুলে ওঠা ও অস্বস্তিকর ব্যথার মতো সমস্যা হতে পারে। অবসাদের পাশাপাশি চুলকানি, ফুসকুড়ি, হাত-পা-মুখে ক্ষত দেখা যায়।
গুটিবসন্ত জাতীয় রোগটিতে সাধারণত ফুসকুড়ি ওঠে। তারপর তা ফোসকায় রূপ নেয়, আর শেষে খোশপাঁচড়া হয়ে তা শরীরে যন্ত্রণা দেয়। রোগটির প্রাদুর্ভাব হয় ছোট আকারে, পরে নিজে নিজেই শেষ হয়ে যায়। অধিকাংশ আক্রান্তের যৌনাঙ্গ ও তার চারপাশে ক্ষত দেখা গেছে। বেশিরভাগ রোগী সমকামী ও উভকামী তরুণ।
কী ঘটতে যাচ্ছে?
রোগটি এ পর্যন্ত ভিন্ন এক পরিস্থিতির তৈরি করেছে। যদিও করোনার মতো সবকিছু ওলটপালট করে দেয়নি। বলা হয়, ভাইরাসটি পরিবর্তন হয়েছে। আবার একই জায়গায় একই সময়ে পুরনো ভাইরাস নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
শার্লট হ্যামার বলেন, হয় ভাইরাসটির বর্তমান রূপ সহজাতভাবেই ভিন্ন, নতুবা মানবদেহে রোগটির প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে। অথবা আমরা একটি সংক্রমণ ঝড়ের মুখোমুখি, যাতে ভাইরাসটি এভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারছে। আর এমনটি হওয়ার শঙ্কাই বেশি বলে মনে করি।
অতীতে যে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া হয়েছিল, তার প্রভাব কমছে। এতে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না। কিছু মানুষের মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে গেছে।
নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেইথ নেইল বলেন, এটিকে খুব বেশি প্রাণঘাতী বলে মনে হচ্ছে না। তবে সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়তে পারে।
মাঙ্কিপক্স একটি ডিএনএ ভাইরাস। কাজেই করোনা কিংবা ফ্লু জাতীয় ভাইরাতের মতো এটি পরিবর্তিত হয় না। অর্থাৎ আরএনএ ভাইরাস যেভাবে পরিবর্তিত হয়, মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটনার শঙ্কা কম।
সব মিলিয়ে হতাশ হওয়ার মতো কিছু নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক কেইথ নেইল। শুরুর দিনগুলোর জিনগত বিশ্লেষণ বলছে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ভাইরাসের যে রূপ দেখা গেছে, সেটির সঙ্গে বর্তমান সংক্রমণের নিবিড় সম্পর্ক আছে। তবে এটি কতটা প্রাণঘাতী কিংবা সক্রিয় তা নিয়ে বলার সময় এখনো আসেনি।
বর্তমান ধরন নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে গেলে আরও সময় নিতে হবে। গেল দশকে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাদুর্ভাব ছড়ায় ইবোলা ও জিকা ভাইরাস। কিন্তু এ রকম কোনো বিপর্যয় ঘটাতে মাঙ্কিপক্সকে পরিবর্তিত হওয়ার দরকার নেই।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক অ্যাডম কুসারকি বলেন, আমরা সবসময় ভাবতাম ইবোলা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। অথচ তা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু সমকামী ও উভকামীরা মাংকিপক্সে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কেন, তা নিয়েও নির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলনি। প্রশ্ন জাগতে পারে, যৌন আচরণ কি ভাইরাসটির বিস্তার সহজতর করছে?
অতীতে গুটিবসন্ত প্রতিরোধে ব্যাপক টিকা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এতে মাঙ্কিপক্স সংশ্লিষ্ট রোগ থেকে আগের প্রজন্ম কিছুটা সুরক্ষিত থাকছেন। তবে রোগটি নিজে নিজেই শেষ হয়ে যাবে বলে মনে মনে করেন ডা. অ্যাডলার।
তিনি বলন, গুটিবসন্ত আমলের চেয়ে রোগটি বর্তমানে অনেক বেশি কার্যকরভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে বেপরোয়াভাবে ছড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
রোগটি কী নিয়ন্ত্রণের বাইরে?
রোগ বিস্তারের কোনো বড় ঘটনা বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে পারে। ধরুন, বিপুলসংখ্যক মানুষ এক জায়গায় জড়ো হলেন, সেখান থেকে মাঙ্কিপক্স বহন করে তারা বিভিন্ন দেশে চলে গেলেন। এভাবে দেশে দেশে ছড়াতে পারে প্রাদুর্ভাবটি।
বিকল্প ব্যাখ্যাও আছে। বহু আক্রান্ত আছে এমন, কীভাবে তাদের দেহে ভাইরাসটি এসেছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ কখনো-কখনো লোকজনের শরীরে অজান্তে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। এতে তা ব্যাপক রূপ নিতে পারে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক জিমি হোয়াইটওয়ার্থ বলেন, আমি মনে করি, বর্তমান স্তরে সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার। আমরা এখনই সবকিছু আবিষ্কার করতে পারব না। রোগটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। যে কারণে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাসের মতো একই ধরনের আমরা পরিস্থিতিতে নেই। মাঙ্কিপক্স নতুন কোনো রোগ না। আগেও ছিল। রোগটির সংক্রমণ হালকা। কিন্তু শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও কোনো স্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য ভাইরাসটি প্রাণঘাতী হতে পারে।
করোনার চেয়ে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণের গতি ধীর ও স্বতন্ত্র। কাশি না-হলেও যন্ত্রণাদায়ক ফোসকা-ফুসকুড়ির জন্য রোগটি সামলানো কঠিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপীয় পরিচালক হ্যানস ক্লুগ বলেন, আমরা গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এতে বিপুল জমায়েত ও উৎসব অপেক্ষা করছে। ফলে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক হেইম্যান বলেন, আসছে দিনগুলোতে দেশগুলোকে নির্দেশনা দেবেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রীষ্মের উৎসবগুলোতে রোগটি বাড়তে পারে। ইতিমধ্যে জরুরি বৈঠকের আয়োজন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।