দেশে করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। গত কয়েক দিনে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে মৃত্যুও। কিন্তু সেবা দেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোভিড, নন-কোভিড হাসপাতালগুলো সেভাবে তৈরি হয়নি।
করোনা নির্ধারিত ওয়ার্ডে অন্যদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মুর্মূষু রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য আইসিইউ শয্যাগুলো আলাদা করা হয়নি। একাধিক হাসাপাতাল ঘুরে প্রস্তুতির ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে।
এছাড়া জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব তীব্র। অধিকাংশই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিষয়গুলো উপেক্ষিত। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার আগের সংক্রমণের সময় রাজধানীতে পাঁচটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালসহ বিভাগ, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে আলাদা ইউনিট ছিল। পরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় সেগুলোতে সাধারণ রোগীর সেবা চালু হয়।
ফলে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত আইসিইউ, এইচডিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম অকেজো পড়ে থাকে।
এর মধ্যে মহাখালীর ডিএনসিসি ও বিএসএমএমইউর কোভিড হাসপাতাল ছাড়া সবকটিতে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয়। এখন করোনা রোগী বাড়ায় অন্যান্য হাসপাতাল প্রস্তুতির কথা বললেও কোভিড চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো পুরোপুরি ঠিক করা হয়নি।
সেখানে প্রস্তুতির ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে। ঊর্ধ্বমুখী করোনা সংক্রমণে নন-কোভিড চিকিৎসাকেন্দ্র হাত গুটিয়ে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড হাসপাতালের বাইরে নন-কোভিড হাসপাতালেও করোনাক্রান্ত অনেকেই যাচ্ছেন। অনেকের সেখানে নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে করোনা শনাক্ত হচ্ছে। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নামেমাত্র একটি ইউনিট আছে।
তবে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, জাতীয় পক্ষাঘাত ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল), জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কোনো কোভিড ইউনিট খোলা হয়নি।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ রোধে তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির যুগান্তরকে বলেন, ফের পাল্লা দিয়ে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি রয়েছে। নতুন করে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনন্দিন করোনাসংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৫০টি কোভিড শয্যা উল্লেখ থাকলেও রোববার সরেজমিন গিয়ে দ্বিতীয় তলার সার্জারি ওয়ার্ডের ৯নং কেবিন ওয়ার্ডে ১৪ জন কোভিড রোগী ভর্তি দেখা যায়।
এই ইউনিটে দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহিনা বেগম যুগান্তরকে বলেন, রোগী বাড়লেও এখনো আলাদা ওয়ার্ড করা হয়নি। প্রাথমিকভাবে ৯নং কেবিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে। সবাই পজিটিভ না। অনেকের উপগর্স থাকলেও ভর্তি রাখা হচ্ছে।
এছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১০টি কোভিড আইসিইউর কথা বলা হলেও চিকিৎসকরা জানান সেখানে কোভিড আইসিইউ নেই। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দুই পাশে হাত ধোয়ার জন্য ৬টা বেসিন ও মেডিসিন ভর্তি রুমের পাশে তিনটা বেসিনের সবই অকেজো পড়ে থাকতে দেখা যায়।
নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র লেখা কাচের বুথটি বহির্বিভাগের সামনে অনাদরে পরে থাকতে দেখা যায়। দ্বিতীয় তলার অপারেশন থিয়েটার ও আইসিইউ কমপ্লেক্স সচল থাকলেও পাশে কোভিড আইসিইউ লেখা কক্ষটিতে ভাঙাচোরা বিছানা ও চেয়ার টেবিল স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে।
কোভিড ডেডিকেটেড মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল আগে থেকেই কোভিড ডেডিকেটেড। মাঝে সংক্রমণ কমে যাওয়ায় সাধারণ রোগীর সেবাদান শুরু হয়।
এখন আবার বাড়ছে। রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত আটজন ভর্তি হয়েছেন। বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে ১২ জনের মতো রোগী আসছে। তিন-চারজন ভর্তি হচ্ছে। প্রস্তুতি আছে, রোগী এলে ট্রায়াজ ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রয়োজন হলেই ভর্তি করা হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘আমাদের ভর্তি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে পাঁচজনের নিচে রোগী ভর্তি ছিল, সে সংখ্যাটি এখন ত্রিশের অধিক। আমরা তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছি।’
বিএসএমএমইউ কোভিড হাসপাতালেও রোগীর চাপ কম বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। রোববার বিএসএমএমইউ পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, সংক্রমণ বাড়লেও রোগী হাসপাতালে কম আসছে।
এখনও স্বস্তির পরিবেশ রয়েছে হাসপাতালে। আইসিইউ চাহিদা নেই। মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় কোনো রোগী ভর্তি নেই। এক হাজারের বেশি শয্যার হাসপাতালটিতে এখন মাত্র ১৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।
তাদের সবাই আইসিইউতে। হাসপাতালটিতে এইচডিইউ ২৮৮টি শয্যার মধ্যে বর্তমানে ২৫১ খালি রয়েছে। টানা চার সপ্তাহ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেও হাসপাতালে চাপ কম।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান বলেন, এখন যে পরিস্থিতি, বয়স্ক রোগীরা বেশি আসেন।
এছাড়া কোভিডের সঙ্গে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি, হাইপারটেনশন আছে এমন রোগীরাই বেশি ভর্তি হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নতুন নির্দেশনা এসেছে। সেই অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুস সবুর যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সংক্রমণ পাঁচ শতাংশের বেশি হলেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলা হয়। গত কয়েক দিনে সংক্রমণ ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
আসন্ন ঈদ উপলক্ষ্যে গরুর হাট ও মানুষের স্থান পরিবর্তন বাড়বে। যা সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা জাগাচ্ছে। হাসপাতালে রোগীও বাড়বে। এজন্য শুধু কোভিড ডেডিকেটেড নয় সব হাসপাতালেই রোগী ব্যবস্থাপনায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালগুলোর সব ধরনের প্রস্তুতি থাকতে হবে, যেন রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করানো যায়।
পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। রোগীরা যেন অক্সিজেন সংকটে না পড়েন। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোভিডের পাশাপাশি রোগীর অন্যান্য ক্লিনিক্যাল অবস্থা মোকাবিলার সক্ষমতা থাকতে হবে।