আজিজুল ইসলাম বারী,লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ নিবন্ধিত মিলারদের নামে বরাদ্ধকৃত চাল নিজেই নিজের গুদামে বিক্রি করতেন ২৫০ টন সরকারি চাল তছরুপের দায়ে গ্রেপ্তার লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা খাদ্য পরিদর্শক ফেরদৌস আলম। তাকে গতকাল রোববার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
তছরুপকৃত চালের সঠিক পরিমাপ জানতে গুদামের চাল পরিমাপ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। সেক্ষেত্রে রোববার দিনভর মাত্র একটি খামাল পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছে কমিটি। সে অনুযায়ী পুরো গুদাম পরিমাপ করতে তদন্ত কমিটির সময় লাগবে আরও ১৬ দিন। যদিও তদন্ত প্রতিবেদন ৫ কর্মদিবসে জমা করার নির্দেশ দিয়ে গত শুক্রবার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। আপাতত সিলগালা গুদাম রয়েছে তদন্ত কমিটির তত্ত্বধানে। এরই মধ্যে তছরুপকৃত ২৫০ মেঃটন চালের মধ্যে মাত্র সাড়ে ৫৪ মেঃটন চাল উদ্ধার করেছে তদন্ত কমিটি।
জানা গেছে, নিবন্ধিত ও চুক্তিপত্র অনুযায়ী ৪৮ জন মিলারের মাধ্যমে গত বোরো মৌসুমে উপজেলায় মোট ২ হাজার ৫৮৯ মেঃটন চাল ক্রয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করে খাদ্য বিভাগ। উপজেলার ভোটমারী ও কাকিনায় দুইটি গুদাম রয়েছে। বোরো মৌসুমে চাল বেশি ক্রয় করা হয় ভোটমারী গুদামে। মিলাররা ইচ্ছে মত গুদামে এসব চাল বিক্রি করতে পারতেন। সুযোগ বেশি থাকায় ভোটমারী গুদামে চাল বেশি বিক্রি করতেন মিলাররা। উপজেলার ৪৮ জন মিলারের মধ্যে ৩০ জন মিলার তাদের বরাদ্ধকৃত চাল ভোটমারী গুদামে বিক্রি করেন। বাজারে প্রতি কেজি ৪২/৪২ টাকা হলেও গুদামে প্রতি কেজি চাল কেনা হয় ৪৫ টাকা দরে।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভোটমারী খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম ২৪ জন মিলারের চাল নিজেই নিজের গুদামে ক্রয় করেছেন। তিনি নিজেই ক্রেতা ও বিক্রেতা হওয়ায় চালের মান নিয়েও বিস্তার অভিযোগ রয়েছে। নিবন্ধিত মিলারদের টন প্রতি এক হাজার টাকা হারে প্রদান করে তাদের ব্যাংক হিসাব নম্বরের স্বাক্ষরীত চেক সংগ্রহ করতেন। পরে পছন্দমত কম দামের চাল ক্রয় করে মিলারদের নামে গুদামে বেশি দা বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নিবন্ধিত মিলার বলেন, বোরো মৌসুমে চালের বাজার ভাল থাকায় মিলারদের চাপ দিয়ে প্রায় ২৪ জন মিলারের নামে বরাদ্ধকৃত চাল নিজে গুদামে বিক্রি করেছেন। তার কথার বাহিরে গেলে লাইসেন্স বাতিলসহ বরাদ্ধ কমে দেয়ার হুমকী দেয়া হত। নিজেকে বড় আওয়ামীলীগ নেতা দাবি করতেন ফেরদৌস আলম। গত বোরো মৌসুমে আমরা মাত্র ৬ জন মিলার সরাসরি গুদামে চাল দিতে পেয়েছি। সেই চাল দিতেও টন প্রতি ৫শত টাকা বখশিস দিতে হয়েছে।
গ্রেপ্তার ফেরদৌস আলমের সাথে সখ্যতা থাকা মিলাররা ঘটনার পর থেকে গাঢাকা দিয়েছেন। ফেরদৌস আলম তার পছন্দের মিলারদের আগাম টাকা দিয়ে গুদামে চাল কিনতেন। তার মধ্যে দু একজন মিলার টাকা উত্তোলন করেও গুদামে চাল না দেয়ায় গুদামে সংকট বেড়ে যায়। এতে অনেকটা বিপাকে পড়েন ফেরদৌস আলম। গুদামের হিসাব ঠিক রাখতে সুড়ঙ্গ করে হিসাব গোজামিল দিতেন ফেদৌস। সেক্ষেত্রে খামালের মাঝে খালি বস্তা রেখে সুড়ঙ্গ করতেন। পরিদর্শনে খামালের সারি অনুযায়ী বস্তার হিসাব কাগজ কলমে ঠিক রাখতেন। যার কারনে দীর্ঘ দিনের এ সংকট পরিদর্শনকারী কর্মকর্তার নজর এড়িয়ে যায়।
প্রথম অভিযান উদ্ধার ৩০ মেঃটন চাল উপজেলার সুকানদীঘি বাজারের একমাত্র সুটার মিল একরামুলের চাতালে পাওয়া যায়। যে চাল ফেরদৌস আলম মিলার শফিকুলের মাধ্যমে সুটার করতে ওই চাতালে পাঠান। খবর পেয়ে ইউএনও সেখান থেকে ৩০ মেঃটন উদ্ধার করেন।
সুটার মিলের মালিক একরামুল হক বলেন, পুরো উপজেলা মিলে একমাত্র চাল সুটার মিল আমার। খাদ্যগুদাম, মিলার ও চাল বিক্রেতারা এখান থেকে চাল সুটার করে থাকেন। প্রতিদিনের মত সেদিনও মিলার শফিকুল ৩০ মেঃটন চাল সুটার করতে পাঠায়। আমি তা সুটার করার আগেই ইউএনও স্যার এসে গুদামের চাল দাবি করলে আমি দিয়ে দেই। পরবর্তিতে শফিকুলের সাথে অনেক বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। উদ্ধারকৃত চাল মিলার শফিকুলের। তাই ঘটনার পর থেকে লাপাত্তা রয়েছেন মিলার শফিকুল। এ বিষয়ে মিলার শফিকুলকে একাধিকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক (ভার) স্বপন কুমার দে বলেন, গুদামে ১৭টি খামাল রয়েছে রোববার দিনভর মাত্র একটি খামাল পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছে। সেই খামালে সুড়ঙ্গ মিলেছে। তাতে ধারনা হচ্ছে তছরুপকৃত চালের পরিমান বাড়তে পারে। অনলাইনে চাল ক্রয় করায় মিলারদের নামে ডিও দেয়া হয়। যার কারনে চাল কর্মকর্তা নিজে কিনেছেন কি না তা কাগজ কলমে বলার উপায় নেই। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ফেরদৌস তেমন কোন তথ্য দিতে পারেননি। শুধুই কান্না করে বলেছেন, “কি থেকে কি হয়েছে আমি কিছুই জানি না”। চাল কোথায় আছে সে তথ্যও তিতে পারেনি।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, গ্রেপ্তার ফেরদৌসের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা করতে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির নেয়া হয়েছে এবং মামলার নথি দুদক কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তছরুপকৃত চালের বিষয়ে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন দুদক। আমরা প্রাথমিক ভাবে যেটুকু তথ্য পেয়েছি তার আলোকে অভিযান চালিয়ে দুই দফায় সাড়ে ৫৪ মেঃটন চাল উদ্ধার করে জব্দ করেছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা (ওসি-এলএসডি) খাদ্য পরিদর্শক ফেরদৌস আলম গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে ২৫টি ট্রলিতে গুদাম থেকে ২৫০ টন চাল সরিয়ে লাপাত্তা হন। তছরুপ করা চালের মূল্য প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। শুক্রবার সকালে এমন গোপন খবরে জেলা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে গুদামে অভিযান চালান কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহির ইমাম। চালের হিসাবে গরমিল ও কর্মকর্তা নিখোঁজ থাকায় গুদাম সিলগালা করা হয়।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সকালে উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের সুকানদীঘি এলাকার চালকলমালিক একরামুল হকের গুদাম থেকে ৩০ টন ও রওশন ফিলিং স্টেশন এলাকায় দাড়িয়ে থাকা ট্রাক থেকে সাড়ে ২৪ মেঃটন চাল করে জব্দ করেন কালীগঞ্জের ইউএনও জহির ইমাম। শনিবার বিকেলে দলগ্রাম কলাবাগান এলাকা থেকে খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলমকে গ্রেপ্তার করে রোববার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ।