

বনানীর প্রাইম এশিয়ার শিক্ষার্থী ছাত্রদল কর্মী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যার মূল হোতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবুজর গিফারী পিয়াস। শিঙাড়ার দোকানে হাসাহাসি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসার পরও বান্ধবীর কাছে হিরো সাজতে সে ‘হায়ার’ করে বনানী এলাকার বেনসন গ্রুপসহ দুই কিশোর গ্যাং।
বিশ্ববিদ্যালয় গেটে ডেকে আনে অন্য বন্ধুদেরও। সবাই মিলে অতর্কিতে হামলা চালায় পারভেজের ওপর। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত এবং গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে সেই তথ্য এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না। ঘটনার মূলহোতা আবুজর গিফারী পিয়াস ও তার বান্ধবী ঐশিসহ দুই তরুণীকে এখনো খুঁজে পায়নি পুলিশ।
১৯ এপ্রিল বিকালে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উলটোদিকে একটি শিঙাড়ার দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় হাসাহাসি করছিলেন জাহিদুল ইসলাম পারভেজ। তাদের পেছনে বসেছিলেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের দুই শিক্ষার্থী ফাতেমা তাহসিন ঐশি ও ফারিহা হক টিনা। একপর্যায়ে ঐশি তার ছেলেবন্ধু প্রাইম এশিয়ার এলএলবির ছাত্র আবুজর গিফারী পিয়াসকে ফোন করে অভিযোগ করেন, তাদের (ঐশি-টিনা) উদ্দেশ করে হাসাহাসি করা হচ্ছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাহাথীর ও বিবিএর মেহেরাজকে সঙ্গে নিয়ে পিয়াস ওই দোকানে যান। হাসাহাসির প্রসঙ্গ নিয়ে পারভেজের সঙ্গে তারা কথা কাটাকাটি করেন। একপর্যায়ে বিষয়টি প্রাইম এশিয়ার প্রক্টরকে জানানো হয়। প্রক্টর পারভেজকে ডেকে নিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। পারভেজ ওই দুই শিক্ষার্থীর কাছে ঘটনার জন্য ক্ষমাও চান।
এরপরও বান্ধবীর কাছে হিরো সাজতে পিয়াস তার এলাকার বন্ধুদের এবং বনানী কড়াইল বস্তি এলাকার কিশোর গ্যাং বেনসন গ্রুপের সদস্যদের ফোনে ডেকে আনেন। তারা ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে লাঠিসোঁটা, ছুরি-চাকু ও চাপাতি নিয়ে এসে পারভেজ ও তার বন্ধু তারিকুল ইসলামকে মারধর করে। একপর্যায়ে তাদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে মারা যান পারভেজ। এই ঘটনায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য আল কামাল শেখ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহাথীর হাসান আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এছাড়া র্যাবের হাতে গাইবান্ধা থেকে গ্রেফতার প্রধান আসামি মেহেরাজ ইসলামকে শুক্রবার ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ নিয়ে আলোচিত এই মামলায় চারজন রিমান্ডে রয়েছেন। রিমান্ডে থাকা অপর তিনজন হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বনানী থানার কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব মো. হৃদয় মিয়াজী, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য আলভী হোসেন জুনায়েদ ও আল আমিন সানি।
পুলিশ জানায়, এই ঘটনার অন্যতম হোতা আবুজর গিফারী পিয়াস, বান্ধবী ফাতেমা তাহসিন ঐশি এবং অপর তরুণী ফারিহা হক টিনাকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। রিমান্ডে থাকা আসামিরা বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ। সূত্রমতে, হামলাকারীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র এবং বনানী এলাকার দাপুটে কিশোর গ্যাং বেনসন গ্রুপের সদস্যদের উপস্থিতির বিষয়টি ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়েছে। তার ভিত্তিতে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। যারা রিমান্ডে রয়েছেন, তাদের ফুটেজ দেখিয়ে হামলাকারীদের নাম-পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। রিমান্ডের এই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে বনানী ও মহাখালী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মের তথ্যও উঠে এসেছে। এ পর্যন্ত হামলায় অংশ নেওয়া ১২ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবুজর গিফারী পিয়াস ও তার বান্ধবীকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে আসছে নিহত পারভেজের পরিবার।
জানা গেছে, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবির শিক্ষার্থী আবুজর গিফারী পিয়াস ও ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের দুই শিক্ষার্থী ফাতেমা তাহসিন ঐশি ও ফারিহা হক টিনা বনানী বিদ্যানিকেতনে পড়াশোনা করেছে। পিয়াস ও ঐশির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। পিয়াসের বাসা মহাখালী আমতলা এলাকায়। মহাখালী ও কড়াইল বস্তি এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সেই সম্পর্ক তিনি ঘটনার দিন কাজে লাগান। মেহেরাজ নিজেও মহাখালীর হাজীরবাগ এলাকার একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং পিয়াসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পিয়াস, মাহাথীর ও মেহেরাজ প্রাইম এশিয়ায় পড়াশোনা করলেও এলাকার দুই কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে নানা অপকর্মে লিপ্ত।
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল সারোয়ার বলেন, যারা রিমান্ডে রয়েছেন, তাদের হত্যা ঘটনাসহ সেদিনের ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি এবং ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বনানীতে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যার পরদিন ২০ এপ্রিল নিহতের মামাতো ভাই হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে বনানী থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় আটজনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ২০-৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।