রাজধানীর রাজপথে সাধারণত গাড়িচালকের আসনে দেখা যায় পুরুষকে, মাঝে মধ্যে নারীকেও দেখা যায়। তবে এবারই প্রথম গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে চালকের আসনে বসে থাকতে দেখা গেল তৃতীয় লিঙ্গের বুলবুলিকে (২৫)।
চাঁদাবাজি বা ভিক্ষা করে নয়, সমাজে সাধারণ মানুষের মতো সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে জীবন কাটাতে চান বুলবুলি। তিনি নিজেকে প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের গাড়িচালক হিসাবেও দাবি করেছেন। বুলবুলি জানান, আমরা অর্ধনারী, আমরাও কিছু করতে পারি।
রাজধানীর মিরপুর-১৪ এলাকায় কথা হয় বুলবুলির সঙ্গে। তিনি বলেন, আল্লাহর রহমতে এখন ভালোভাবে গাড়ি চালাতে পারি। পার্কিং ও ঝিকঝাক সংকেত সবকিছু শিখেছি। গাড়ি চালাতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমি পূর্ণাঙ্গ গাড়িচালক। বুলবুলি নড়াইলের সদর কুমখালী গ্রামের মৃত মুক্তিযোদ্ধা আফজাল মোল্লার সন্তান। তবে তিনি রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।
নিজ উদ্যোগে বুলবুলিকে ড্রাইভিং শিখিয়েছেন শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের শিফট ইনচার্জ (প্রভাতী) ও সহকারী অধ্যাপক কাজী বদরুজ্জামান (জামান) ও ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান। বুলবুলি জানান, আট ভাইবোনের মধ্যে ষষ্ঠ তিনি। বাবা কৃষক ছিলেন। তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টা বুলবুলি যখন জানতে পারলেন, তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এক সময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভারতেও গিয়েছিলেন। পরে দেশে ফেরেন। বুলবুলি নিজেকে দমিয়ে রাখেননি। তিনি এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে এখন ডিগ্রিতে পড়ছেন।
তিনি বলেন, নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গের জেনে প্রথম প্রথম সংকোচ হতো। সবসময় ছেলে সেজে প্যান্ট-শার্ট পরে স্কুল ও কলেজে পড়েছি। তবে পরে নিজেকে বুঝিয়ে স্বাভাবিক হয়েছি। এখন একটাই প্রত্যাশা, যেন সরকারি গাড়িচালক হতে পারি।
বুলবুলি বলেন, গাড়ি চালানোর পাশাপাশি তিনি কুরআন তেলাওয়াত করেন। আগে কষ্টে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে করে আবেগে কেঁদে ফেলেন বুলবুলি। তিনি বলেন, আমরা সমাজ ও পরিবারে বঞ্চিত, সবার কাছে অবহেলিত। সমাজের বোঝা হয়ে নয়, অন্যদের মতো সম্মানজনক কাজ করে খেতে চাই। আমার সার্টিফিকেট আছে, গাড়ি চালাতে পারি। এছাড়া আমি শিক্ষিত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় একটি সরকারি চাকরি পেলে অন্য পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব।
শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের সহকারী অধ্যাপক কাজী বদরুজ্জামান (জামান) জানান, সড়কে ও গাড়িতে তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে ভিক্ষা বা চাঁদাবাজি করতে দেখলে কষ্ট পাই। মনে হয় তারাও তো মানুষ। তাদেরও স্বাভাবিকভাবে চলার, কর্ম করে খাওয়ার অধিকার আছে। দেশে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছে। তারাও কাজ করে দেশের সম্পদে পরিণত হবে। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি আমাকে ভাবিয়েছে।
এ নিয়ে আমি ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলি। তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজনকে গাড়ি চালানো শেখানোর প্রস্তাব জানাই। তিনিই আমাকে বুলবুলি, রাখিসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। গাড়ি চালানো শেখানোর কথা জানালে তারা আগ্রহ প্রকাশ করে। দুজন গাড়ি চালানো শিখেছে। আরও একজন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এখন তাদের প্রত্যাশা গাড়িচালক হিসাবে সরকারি একটি চাকরি।
মিরপুর এলাকার গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষক আলাউদ্দিন জানান, বুলবুলি দুই মাসে গাড়ি চালানো শিখেছেন। তিনি অনেক ভালো গাড়ি চালান। তাদের ব্যবহারও অনেক ভালো।