বিশ্ববাজারে সারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি বাজেটে কৃষি খাতের ব্যয়ের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
আর এই দাম বেড়েছে শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খেসারত দিচ্ছে দেশের কৃষি খাত। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় সম্প্রতি সংশোধিত বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। এই অর্থের বড় অংশই চলে যাবে সার কেনার বর্ধিত মূল্য পরিশোধে।
এমন পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সারের মূল্য সমন্বয় প্রস্তাব কার্যকর করেনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এমন পরিস্থিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক খাদ্যশস্য ফলন হবে এমনটি পূর্বাভাস দিয়েছে সরকার। ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি খাতে সম্পৃক্ত মানুষের আয় বাড়বে এমনটি প্রত্যাশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেছেন, বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশে খাদ্য সংকট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এই মুহূর্তে মাঠে ধানের অবস্থা ভালো। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৯০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। হাওড়ে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে আগাম বন্যায় প্রায় সাত হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সময়মতো বাঁধ রক্ষা, অনুকূল আবহাওয়া ও যন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে ধান কাটার ফলে ইতোমধ্যে হাওড়ের ধান ঘরে তোলা গেছে।
সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি ও জ্বালানি খাতে এই সময়ে ভর্তুকি কমানো যাবে না। এই ভর্তুকির ঘাটতি মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণ আরও বাড়াতে হবে। তাহলে ভর্তুকি বাড়ালেও রাজস্ব আয় দিয়ে সেটি ব্যালেন্স করা যাবে। তবে কিছু খাতে এ মুহূর্তে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় কমাতে হবে। এদিক থেকে কিছু অর্থ সাশ্রয় হবে।
জানা গেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে এমনটি ধরে চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) শুরুতে কৃষি খাতের ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়। কিন্তু বছরের শেষদিকে এসে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক বেড়ে যায় কৃষি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। ফলে শেষদিকে এসে কৃষকের সার ইউরিয়া প্রতিকেজির মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ৩২ থেকে বেড়ে ৯৬ টাকায় দাঁড়ায়।
একই সঙ্গে টিএসপি সার ৩৩ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা, এমওপি সার ২৩ থেকে বেড়ে ৫৪ টাকা এবং ডিএপি সারের মূল্য ৩৭ থেকে বেড়ে ৯৩ টাকায় ওঠে। সরকার বিশ্ববাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে আমদানি করলেও কৃষকের কথা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশে মূল্য বৃদ্ধি করেনি।
ফলে এ খাতে বড় ধরনের ভর্র্তুকি গুনতে হচ্ছে। যে কারণে সংশোধিত বাজেটে কৃষি খাতের ভর্তুকি ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। সার ছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পণ্য ও সেবা ক্রয় খাতে এ বছর ব্যয় বেড়েছে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সংশোধিত বাজেটে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে পরিচালনা ব্যয়ের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৩ হাজার ১৭১ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা আরও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ফলে পরিচালনা এ খাতে মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি উন্নয়ন খাতে ১৬৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিচালনা ও উন্নয়ন খাতে শুরুতে বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। সেটি সংশোধিত বাজেটে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে মোট ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা।
কৃষকদের অসুবিধা এড়াতে সরকার জাতীয় নির্বাচনের আগে রাসায়নিক সারের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, আগামী অর্থবছরের সার প্রণোদনা (ভর্তুকি) ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি করা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকে সারের মূল্য সমন্বয় করতে অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনৈতিক শাখা সুপারিশ করেছে। তিনি বলেন, সারের মূল্য বাড়িয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো অস্থিরতা চায় না।
ব্যয়ের ক্ষেত্রে অস্বস্তি থাকলেও চলতি অর্থবছরে ফসল উৎপাদনে স্বস্তির আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
এ বছর মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন। সর্বশেষ তথ্য মতে, ধারণা করা হচ্ছে ফসলের মোট উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭১ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে আমনের উৎপাদন বেশি হবে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। আমনের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দেড় কোটি মেট্রিক টন।
উৎপাদন হতে পারে ১ কোটি ৫৬ লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া আউশ পাওয়া যাবে ৩৪ লাখ ৫২ হাজার টন, বোরোর ফলন হবে ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টন, গমের ফলন হবে ১২ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন ও ভুট্টা ৫৮ লাখ ৭৫ হাজার টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, দেশের অর্থনীতি রূপান্তরের সময় কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এমনকি করোনা মহামারিতেও এ খাতে কোনো ঋণাত্মক প্রভাব পড়েনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় ভূমিকা রাখছে এ সময় কৃষির প্রবৃদ্ধি।