• আজ ১০ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রংপুরের অনগ্রসর নারীদের আলোবর্তিকা হয়ে উঠছে ‘প্রজেক্ট স্বচ্ছ’

| নিউজ রুম এডিটর ৬:১৩ অপরাহ্ণ | আগস্ট ৩১, ২০২৫ শিক্ষাঙ্গন

 

রুশাইদ আহমেদ: “খাওয়ার আগে আমাদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস ছিল না। এখন বুঝেছি শরীরে জীবাণু কীভাবে ছড়ায়। ‘প্রজেক্ট স্বচ্ছের’ সহায়তায় আমরা এখন নিজেদের তৈরি সাবান ব্যবহার করছি, যা বাজারের অন্যান্য রাসায়নিকযুক্ত সাবানের চেয়ে অনেক ভালো,” বলছিলেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় বিভাগীয় শহর রংপুরের রেলওয়ে কলোনিতে বসবাসরত নারী নার্গিস বেগম।

সাম্প্রতিক সময়ে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে ‘Project Swaccho – প্রজেক্ট স্বচ্ছ’ নামের একটি ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাত উদ্যমী শিক্ষার্থী। নার্গিস বেগম সেই প্রজেক্টের অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের একজন।

মূলত, রংপুর নগরীর লালবাগ এলাকা সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনিতে বসবাসরত অনগ্রসর ১০ জন নারীকে নিয়ে শুরু হয় প্রজেক্টটির প্রশংসনীয় এই যাত্রার। দুই মাসব্যাপী এই প্রজেক্টটির কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল এলাকাটির অনগ্রসর নারীদের পরিবেশবান্ধব সাবান তৈরির প্রশিক্ষণ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য সচেতন করে গড়ে তোলা।

প্রজেক্টটি বাস্তবায়নে কাজ করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত তরুণ উদ্যোক্তা: মোছা. মুনতাস তামান্না, মোছা. আতিকা বানু, মো. মুনিরুল ইসলাম, রাকিবুল হাসান মুন্না, তৃষা কুন্ডু, রুপা চক্রবর্তী ও সাথী রানী।

এ দিকে, প্রজেক্টটির অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা এখন প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে নিজ হাতে প্রস্তুতকৃত সাবান বাজারজাত করছেন। ফলে ‘প্রজেক্ট স্বচ্ছ’ এলাকাটির অনগ্রসর নারীদের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের এক মোক্ষম দ্বার। পাশাপাশি, ‘প্রজেক্ট স্বচ্ছ’-এর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেখানকার অনগ্রসর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হয়ে উঠছে স্বাস্থ্য সচেতন। এক কথায় বলতে গেলে এলাকাটির অনগ্রসর ৬-৭ হাজার বাসিন্দাদের জন্য কার্যত “আলোকবর্তিকা”-য় পরিণত হয়েছেন প্রজেক্টটির বাস্তবায়নকারীরা।

উল্লেখ্য, নিম, অ্যালোভেরা, হলুদসহ নানা ভেষজ উপাদানে ‘প্রজেক্ট স্বচ্ছ’-এর উদ্যোগে তৈরি প্রাকৃতিক সাবান ইতিমধ্যেই অনলাইন ও স্থানীয় বাজারে সাড়া ফেলেছে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত এই উদ্যোগ স্থানীয় প্রান্তিক নারীদের জীবনে আত্মনির্ভরতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে মত অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের।

‘প্রজেক্ট স্বচ্ছ’-এর অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোর্শেদা আক্তার এ প্রসঙ্গে জানান, প্রজেক্ট স্বচ্ছের প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা শিখেছি কীভাবে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে সাবান তৈরি করা যায়। এটা আমাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য সচেতনতার গুরুত্ব সম্পর্কেও প্রজেক্টটির প্রশিক্ষণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি। প্রজেক্টটির অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা এখন সপরিবারে স্বাস্থ্য সচেতনতার মৌলিক বিষয়াদি অনুসরণে আগ্রহী হচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রজেক্টটির কার্যক্রম নিয়ে বাস্তবায়নকারী সদস্য তৃষা কুন্ডু বলেন, প্রজেক্ট স্বচ্ছ আমাদের কাছে শুধু একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ নয়; পরিচ্ছন্নতা, সচেতনতা ও আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে একটি সুন্দর ও সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার এটি। শুরুতে আমরা সীমিত পরিসরে কাজ করলেও, এই কাজের ভেতর দিয়েই আমরা শিখেছি—বড় পরিবর্তনের যাত্রার সূচনা হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ থেকে। কোনো সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, রংপুর রেল কলোনিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখানকার শিশুদের হাসি, সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা আমাদের শক্তি জুগিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিটি সেশনে আমরা টের পেয়েছি মানুষ আসলে সচেতন হতে চায়, শুধু দরকার একটু দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ। সেই সুযোগটি করে দিতেই আমরা কাজ করছি।

তৃষা কুন্ডু বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, স্বচ্ছ পরিবেশ মানেই একটি সুস্থ ও সবল প্রজন্ম। ফলে সুস্থ ও সবল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণের পথে সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে ‘প্রজেক্ট স্বচ্ছ’ এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রজেক্টটির অন্যতম উদ্যোক্তা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী রুপা চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য অনগ্রসর নারীদের আত্মনির্ভরশীল ও স্বাস্থ্য সচেতন হিসেবে গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে এরই মধ্যে আমরা প্রথম ধাপে ১০ জন নারীকে নিয়ে কাজ শুরু করেছি।”

রুপা বলেন, রংপুর নগরীর রেলওয়ে কলোনির পশ্চাৎপদ নারীরা এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিবেশবান্ধব সাবান তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি, তারা স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপরও জোর দিচ্ছেন এখন। প্রজেক্টটির আওতায় ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ পরিসরে সংশ্লিষ্টদের কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক সাইফুদ্দীন খালেদ বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ‘প্রজেক্ট স্বচ্ছ’ একটি অনন্য উদাহরণ—যেখানে শিক্ষা শুধু শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনগ্রসর নারীদের নিয়ে প্রাকৃতিক সাবান উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে তাঁরা কেবল আয়ের সুযোগই সৃষ্টি করছেন না, বরং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রও প্রসারিত করছেন।

একইসঙ্গে, স্বাস্থ্য সচেতনতার সেশনগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সাইফুদ্দীন খালেদ। তাঁর মতে, এ ধরনের কার্যক্রম স্থানীয় পর্যায়ে ‘মাইক্রো-এন্টারপ্রেনারশিপ’-এর সুযোগ তৈরি করে টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি মজবুত করবে। এই উদ্যোগকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও উদ্ভাবনী নেতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলেও আখ্যা দেন তিনি।