

মোঃ সাইফুল্লাহ খাঁন :মানুষের মুখের শব্দই হতে পারে সমাজ গঠনের হাতিয়ার—আবার ধ্বংসের অস্ত্রও। একটি মিথ্যা, এক ফোঁটা গুজব কিংবা কারো পেছনে লাগাতার চোগলখোরি কেবল একজন মানুষ নয়, একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান, এমনকি একটি জাতিকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। বর্তমান সমাজে এইসব ব্যাধি যেন ছড়িয়ে পড়েছে মহামারির মতো।
এই ফিচারে আমরা বিশ্লেষণ করবো—মিথ্যা, গুজব, চরিত্রহনন, চোগলখোরি ও বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের ভয়াবহতা, ইসলামী দৃষ্টিকোণ এবং সমাধানের বাস্তব পথ।
১. মিথ্যার দানবীয় ছায়া:
একটি মিথ্যা কথা অনেক সময় সত্যের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে, কারণ তা সাধারণত চটকদার, আবেগপ্রবণ ও জনমনে কৌতূহল উদ্দীপক হয়। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবখানে মিথ্যার জাল বিস্তৃত।
রাসূল (সা.) বলেন:
“তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকো, কারণ মিথ্যা পাপের দিকে নিয়ে যায় এবং পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।” — (বুখারি)
২. গুজবের বিষাক্ত আগুন:
“অমুকের মাথা কেটে নেওয়া হয়েছে”, “অমুক ধর্ম অবমাননা করেছে”, “অমুক শত্রুপক্ষের এজেন্ট”—এই জাতীয় গুজবের কারণে কত নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, গণপিটুনির শিকার হয়েছে, তার হিসাব নেই।
বিশেষ করে ফেসবুক-ইউটিউব ও টিকটকের যুগে গুজব ছড়ানো যেন একধরনের হিংসাত্মক বিনোদন হয়ে উঠেছে।
আল্লাহ বলেন:
“হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা তা যাচাই করে নিও।” — (সূরা হুজুরাত: ৬)
৩. চোগলখোরি: সম্পর্ক নষ্টের নীরব অস্ত্র
চোগলখোর ব্যক্তি দুজনের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করে, ভুল বোঝাবুঝি ও শত্রুতা তৈরি করে।
রাসূল (সা.) বলেন:
“চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” — (সহিহ মুসলিম)
আজ পরিবারে, অফিসে, বন্ধুদের মাঝে এই অসুস্থ চর্চা ভয়াবহ সামাজিক অনাস্থা তৈরি করছে।
৪. ভালো মানুষকে বদনাম দেওয়া: চরিত্র হননের নোংরা খেলা
এই সমাজে যিনি সত্য বলেন, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান, যিনি সৎ—তিনিই যেন সবচেয়ে বড় শত্রু। তার বিরুদ্ধে শুরু হয় অপপ্রচার, ভুয়া পোস্ট, বিকৃত ভিডিও। এটি এক প্রকার চরিত্রহত্যা।
একটি ভালো মানুষের সুনাম ধ্বংস করতে যেমন একটি মিথ্যা তথ্যই যথেষ্ট, তেমনি সেটি ফেরত আনতে তার পুরো জীবন ব্যয় হলেও সম্ভব না।
৫. ডিজিটাল যুগের সাইবার গুজব ও বুলিং:
সাইবার স্পেসে এখন সন্ত্রাস নেই, অথচ সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ গুজব ও অপপ্রচার রয়েছে।
কিশোরী মেয়ের ফেক ভিডিও, ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে সাজানো স্ক্রিনশট, কিংবা নামধারী ইসলামবিদের নামে বিকৃত বক্তব্য ভাইরাল করে চরিত্র হননের খেলা চলছে প্রকাশ্যে।
এই সাইবার বুলিং বহু তরুণ-তরুণীকে আত্মহত্যায় ঠেলে দিয়েছে।
৬. রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব:
রাজনীতি ও ধর্ম—এই দুটি আবেগনির্ভর বিষয়ের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ানো হয়। একপক্ষ অন্যপক্ষকে সমাজ ও ধর্মের শত্রু প্রমাণ করতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এতে দেশের শান্তি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৭. বিচার ব্যবস্থায় মিথ্যা সাক্ষ্য:
একটি সমাজের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারব্যবস্থা। কিন্তু সেখানে যদি মিথ্যা সাক্ষ্য চলে আসে, তবে নিরপরাধ ব্যক্তি জেল খাটবে, আর অপরাধী বুক ফুলিয়ে চলবে।
রাসূল (সা.) বলেন:
“মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরক করার মতোই ভয়ংকর।” — (সহিহ বুখারি)
৮. প্রভাব ও পরিণতি:
সমাজে অনাস্থা ও বিভেদ তৈরি হয়
ভালো মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে
শিশু-কিশোররা মিথ্যা শেখে
মানসিক অবসাদ, আত্মহত্যা বাড়ে
সামাজিক বন্ধন ভেঙে পড়ে
৯. করণীয় ও প্রতিকার:
ক. পারিবারিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে সততার শিক্ষা দিন
খ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করুন
গ. মিথ্যা ও গুজব রটনাকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিন
ঘ. ধর্মীয় নেতা ও ইমামদের দিয়ে খুৎবা ও মাহফিলে এই বিষয়গুলো প্রচার করুন
ঙ. মিডিয়া ও ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্মের দক্ষতা ও দায়িত্ব বাড়ানো হোক
চ. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করার পূর্বে তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তুলুন
ছ. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা না বলার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে
উপসংহারে বলাযায়,মিথ্যা, গুজব, চোগলখোরি, চরিত্রহনন—এসব কিছু যেন সমাজের নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি জাতিকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে দেয়।
সত্যভাষণ, সততা, সচেতনতা ও সম্মান—এই চারটি গুণ যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এসব ব্যাধি নিজে থেকেই দূর হয়ে যাবে।
তাই আসুন, কথার মারপ্যাঁচ নয়—সত্য ও দায়িত্বশীলতা দিয়ে সমাজ গড়ি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, এবং গুজব রটনাকারীদের সামাজিকভাবে বর্জন করি।