• আজ ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জীবনানন্দ, ধানসিঁড়ি এবং ঝালকাঠি।

| নিউজ রুম এডিটর ৯:১৬ অপরাহ্ণ | ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২ শিক্ষাঙ্গন

(রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণ) ‘হায় চিল/সোনালি ডানার চিল/ এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর কেদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে।’ জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল কিংবা বুনোহাঁস, শালিক অথবা ভোরের কাক আজও আছে। কিন্তু কবিতার সেই কালজয়ী ধানসিঁড়ি মরে যাচ্ছে। এক কালের জাহাজ চলা নদীটি আজ নাব্যতা হারিয়ে যেন নি:স্ব। মৃত্যুর পরেও কবি যে নদীটির তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন সে নদীটি হারিয়ে যেতে বসায় কবিতার সেই সোনালি ডানায় চিলেরা যেন কেঁদে মরছে।

ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিশখালি আর সুয়েজ খাল গবাখন চ্যানেলের মোহনা থেকে কবিতার ধানসিড়ি নদীটি প্রবাহিত হয়েছে। এরপর ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের মধ্য থেকে প্রবাহিত হয়ে নদীর অপর প্রান্ত গিয়ে রাজাপুরের বাগড়ি বাজারের তীরবর্তী জাঙ্গালীয়া নদীতে পড়েছে। জনশ্রতি রয়েছে, এক সময় নদীটির প্রসস্ততা এমন ছিল যে, এক ডোঙা ধান সিদ্ধের জন্য সে সময় লাগতো, নদী পার হতেও তত সময় লাগতো। তাই সেকালে নদীটিকে ধান সিদ্ধের বাঁকও বলা হত। আবার কারো কারো মতে এ নদীর বিশাল চরে বড় পরিসরে ধানের চাষ হত। কৃষকরা সে ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য হাজারো মণ ধান আঁটি’র ওপর আঁটি বেঁধে সিড়িঁর মত করে সাজিয়ে রাখত। আর সেখান থেকেই নদীর নাম ধানসিড়ি। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা স্মৃতিচারণ করে বলেন, সে সময় এ নদীতে সুপারির হাট বসত। নদী পথেই মাইলের পর মাইল ছেয়ে যেত হাজার হাজার নৌকায়। দক্ষিনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সুপারির হাট বসতো ধানসিঁড়ি নদীতে। আর এ নদী দিয়েই ভেঁপু (স্টমারের সাইরেন) বাঁজিয়ে বড় বড় সব স্টিমার যেতো খুলনা সহ দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে।

ঝালকাঠির রাজাপুরের অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক সোহরাব হোসেন কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে স্থানীয় ভাবে গবেষণা করছেন অনেক বছর ধরে। তিনি দাবী করেন, বরিশাল ব্রোজমোহন স্কুল শিক্ষক ও ‘ব্র্ক্ষবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রবন্ধকার সত্যানন্দ দাশ ও নারী কবি কুশুম কুমারী দাশের ছেলে জীবনাননন্দ ১৮৯৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি বরিশালে নয়, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের এক বছর পর বাবার শিক্ষকতার চাকরির সুবাদে বরিশালে বসবাস শুরু করে কবি পরিবার। এরপর বেড়ে ওঠা শিক্ষাজীবন সবই বরিশালে। কবির পৈত্রিক বাস ছিলো বিক্রমপুর জেলায়। নদী ভাঙনের কারণে কবির জন্মের আগেই তারা ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠিতে চলে আসেন। কবি মাতা নারী কবি কুসুম কুমারী দাশও জন্মে ছিলেন একই গ্রামে। সে আত্মীয়তার সুবাদেই কবি পিতা স্বপরিবোরে ঝালকাঠি চলে আসেন। জমি কিনে বামনকাঠি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। পরে কবি পিতা বরিশালে বসবাস শুরু করলেও কবির চাচার পরিবার বামনকাঠিতেই ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। কবি পরিবার বরিশাল থেকে গ্রামে আসা যাওয়া করতেন নানা উৎসব আয়োজনে। সে সময় কোলতাকার লেখক কবিদের নিয়েও নানা উৎসব বসতো ঝালকাঠির এই বামনকাঠি গ্রামে। যদিও বিষয়টি সরকারি ভাবে স্বীকৃত নয়। তবে বর্তমানে কেবল ঝালকাঠির গবেষক শিক্ষক সোহবার হোসেনই না গত কয়েক বছর ধরে দেশের অনেক কবি লেখকই ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামকেই কবির জন্মস্থান দাবী করে আসছেন। তবে এ দাবীকে অযৌক্তিক বলেও অনেক কবি মহলের অভিমত। তাই এ বিষয়টি এখন সরকারি ভাবে গবেষণার দাবী রাখছে।

একসময় ধানসিঁড়ি নদী হয়েই বামনকাঠিতে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিলো। এখনও সে পথে ছোট বড় নৌকা চলে। কবি এ পথে যাতায়াত করেছেন বলেই বারবার তার কবিতায় ধানসিঁড়ি এসেছে। আবার আসিব ফিরে কবিতার আরেক পংক্তিতে ধানসিঁড়ি নদীর শাখা রূপসা খালটি উঠে এসেছে কবিতার চরণে এভাবে ‘রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে/ ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে।’ ভৌগলি ভাবে যারা ঝালকাঠির এ রূপসা খালটিকে চিনবেন না তারা হয়তো মনে করবেন, কবি খুলনার রূপসা নদীর কথা বলেছেন। ঝালকাঠির এ রূপসা খালটি ধানসিঁড়ি নদীর একটি শাখা খাল। ঝালকাঠির গাবখান ব্রিজ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বৈদারাপুর গ্রামের ভেতর থেকে চলে গেছে খালটি। কবির গ্রামের বাড়ি দাবী করা বামনকাঠি থেকে তৎকালীন ধানসিঁড়ি নদীতে হয়ত নৌকায় করে কবিও যৌবন কিংবা কৈশোরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর রূপসার সাদা ছেড়াঁ পালে ডিঙ্গা বাওয়া কিশোরটি হয়তো কবি নিজেই।

কবি হায়চিল কবিতায়- ‘হায়চিল সোনালি ডানার চিল/ এই ভিজে মেঘের দুপরে তুমি আর কেদনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে/ তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মত তার ¤øান চোখ মনে আসে/ পৃথিবীর রাঙা রাজ কন্যাদের মত সেজে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;/ আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’ কবিতার সোনালি ডানায় চিলেরা আজও কেদে মরে। তবে এ কান্না ধানসিঁড়ি নদীটির অস্তিত্ব হারিয়ে বিলিন হতে চলার বেদনায়। এক কালের জাহাজ চলা নদীতে আজ যেন নৌকা চলতে ও বাঁধা পায়। নাব্যতা হারিয়ে নদীটি এখন সর্বচ্চ গভীরতায় ৫ ফুট আর চওরায় ৭ ফুটের বেশি নয়। তাই ধান সিদ্ধের বাঁকের কাহিনী কেবলই গল্প এখন। এভাবেই আরও কিছুদিন কাটলে হয়তো নদীটির অস্তিত্ব শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকবে। বছরজুড়ে অসংখ্য পর্যাটক আসছেন কবিতার সেই ধানসিঁড়ি দেখতে। এমনকী কোলকাতা থেকেও কবি কিংবা সাধারণ পর্যটকও আসেন। তবে যে আকাঙ্খা নিয়ে তারা আসেন, নদী দেখে ততটাই হতাশ হন। ধানসিঁড়ি নদীটিকে নিয়ে কবির লেখা ‘সে ’ কবিতার পংক্তিতে কেউ কেউ বলে ওঠেন ‘আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;/বলেছিলো: ‘এ নদীর জল/তোমার চোখের মত ¤øান বেতফল:/সব ক্লান্তি রক্তের থেকে/স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;/এই নদী তুমি।‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?’

ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইয়ে কোন মতে বয়ে চলা এই ধানসিঁড়ি নদীতে আজও পরন্ত বেলায় সূর্যের খেলা। ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানায় এখোন চিল উড়ে বেড়ায়। আর নদীর দুই ধারে গড়ে ওঠা বেরি বাঁধে সাঁরি সাঁরি গাছের ছায়ায় দীর্ঘ মেঠোপথ পর্যটকদের কিছুটা হলেও মন কাড়ছে। সরকারি ভাবে উদ্যোগ নিলে কবি জীবনানন্দের স্মৃতি রক্ষায় নদীটি যথাযথ ক্ষনণ করে পুরোনো ঐতিহ্য অনেকটা ফিরিয়ে আনা যায়। আর এখানে পর্যটকদের জন্য তৈরি করা যায় জীবনানন্দ স্মৃতি জাদুঘর সাথে পর্যটকদের জন্য ছোটখাটো একটি রেস্ট হাউজ। এতে কিছুটা আয়ও হতে পারে। তারচে বড় কথা, জীবনানন্দের কালজয়ী কবিতার ধানসিঁড়ি নদীটি বাঁচিয়ে রাখা জরুরি…