

মস্কো-কিয়েভের মধ্যে চলমান শান্তি আলোচনা কিংবা যুদ্ধের ‘প্রথম পর্বের’ রেশ টানার ঘোষণা সত্ত্বেও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান চূড়ান্তভাবে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর মধ্যেই ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে হামলার জেরে নীরব এক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে রাশিয়ার ওপর, যা আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করছে মস্কোকে। অসন্তোষ বাড়ছে ক্রেমলিনেও। এর ফলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে কি না বা তিনি ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন কি না,
গত মাসে যুদ্ধ শুরুর আগে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামী দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন পুতিন। এ ঘোষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি তাকে। এখান থেকেই স্পষ্ট হয় যে রুশ প্রেসিডেন্টের প্রতি শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে দেশটির আইনপ্রণেতাদের। রাশিয়া সরকারের আইনসভার অন্যতম অংশ এবং জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষের (দুমা) ৪৫০ সদস্যের মধ্যে ৩৫১ জনই পুতিনের এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পুতিনের দল ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর থেকে পুতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা শুধু দীর্ঘই হচ্ছে। এ ছাড়া যুদ্ধের জেরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে রুশ অর্থনীতি, যা ক্ষুব্ধ করেছে দেশটির অনেক ব্যবসায়ীকে। সব মিলিয়ে চলমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিরোধীরা পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য হাত মেলাতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
তবে এ বিষয়ে একমত নন সোভিয়েত-পরবর্তী যুগে বিপ্লব নিয়ে গবেষণা করা ইউক্রেনীয় সমাজবিজ্ঞানী ভলোদিমির ইশচেঙ্কো। পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করার মতো প্রেক্ষাপট এখনো সৃষ্টি হয়নি উল্লেখ করে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য ফলাফল বিপ্লব-এটি আমি মনে করি না। কারণ বিপ্লবের জন্য অভিজাতদের মধ্যে বিভক্তি, বিরোধীদের মধ্যে ঐক্য, সমন্বয় ও সংহতি প্রযোজন হয়।’
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অজনপ্রিয় যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত দুটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল রাশিয়ান সাম্রাজ্য। এর মধ্যে একটি ১৯০৫ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে অপমানজনক পরাজয়ের পর। অন্যটি ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়।
সোভিয়েত পতনের পর অভ্যুত্থানের মুখে পড়ে সদ্য-স্বাধীন অন্যান্য প্রজাতন্ত্রগুলো। উৎখাত হয় জর্জিয়া, আর্মেনিয়া এবং মলদোভা সরকার। সে সময় কিরগিজস্তানে তিনটি এবং ইউক্রেনে সংঘটিত হয়েছিল আরও তিনটি বিপ্লব। তবে গত দুই দশকের মধ্যে একটি লম্বা সময় নিজেকে তথাকথিত বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করার পেছনে কাটিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। যেমন ইউক্রেনে ২০০৪ সালের বিপ্লব, যা ওয়াশিংটনের পরিকল্পনায় সংঘটিত হয়েছিল বলে অভিযোগ রুশ প্রেসিডেন্টের।
জট আছে বিরোধীদের নিয়েও। যেমন বর্তমানে কারাগারে বন্দি আলেক্সি নাভালনি, যার রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবাদ সংগঠিত করতেও সাহায্য করছেন।
সমাজবিজ্ঞানী ভলোদিমির ইশচেঙ্কোর মতে, রাশিয়ায় বিরোধীরা ভালো অবস্থানে নেই। নাভালনির আন্দোলন দমন করা হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিরোধী দলগুলো। কমিউনিস্ট এবং অন্য দলগুলো, যারা বিরোধীদের সঙ্গে মিত্রতা করতে পারত তারা এখন ইউক্রেন যুদ্ধকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তারা পুতিনকেই সমর্থন করছে। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধবিরোধী বেশির ভাগ রাশিয়ান দেশত্যাগ করেছে, যা পুতিনবিরোধী গণবিদ্রোহকে আরও অসম্ভব করে তুলেছে।
‘পুতিনের শত্রু হওয়ার পরিণতি সবার জানা’
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের শুরুতে অন্য সবার মতো হতবাক হয়েছিলেন পুতিনের ঘনিষ্ঠ রুশ অভিজাতদের অনেকে। চলতি মাসের শুরুতে আল-জাজিরাকে এ কথা জানান বিবিসি রাশিয়া এবং টিভি রেইন ও মেডুজার জন্য কাজ করা স্বাধীন রাশিয়ান সাংবাদিক ফরিদা রুস্তমোভা।
কিন্তু যুদ্ধের সেই প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে রাশিয়ান অভিজাতরা নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে শুরু করেছেন উল্লেখ করে ফরিদা বলেন, ‘অনেকে এটির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। সবাই বুঝে গেছেন যে এখন আর কিছু করার নেই। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কোনোভাবে বেঁচে থাকতে হবে। তাদের দেশ ছাড়ারও পথ নেই। কারণ, যুদ্ধ চলাকালীন পদত্যাগ করলে বা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে আপনি বিশ্বাসঘাতক বলে বিবেচিত হবেন এবং সবাই জানে পুতিন বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে কী করেন।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনী বিশেষজ্ঞ পাভেল লুজিন বলেন, ‘পুতিনের চারপাশে কয়েকজন জেনারেল এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন, যা একধরনের রাজনৈতিক সম্প্রদায়। তারা রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারে বিশ্বাস করেন। তাদের জন্য এটি এক ধরনের ধর্ম।’
পাভেল লুজিনের মতে, নিজেকে শাসনব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। আর এভাবে চলতে থাকলে একসময় পুতিনকে উপেক্ষা করে, তাকে ছাড়াই এড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে পারে রুশ প্রশাসন। আর সত্যিই যদি তা হয়, তাহলে কোনো অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ ছাড়াই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে রাশিয়ার রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা।