যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের মামলার নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী তিনি নিু আদালতে হাজির হয়েছেন কি না, এ তথ্যও সংশ্লিষ্ট কারও কাছে নেই।
এর ফলে গত ১৪ বছরে গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়ার সবকিছু একরকম অন্ধকারে রয়ে গেছে। এ সুবাদে অন্যতম আসামি ওবায়দুল করিমসহ দোষীরা আছেন বহাল তবিয়তে। রহস্যজনক কারণে মামলাটি নিয়ে দায়িত্বশীলদের কোনো নজরদারিও পরিলক্ষিত হয়নি।
ওবায়দুল করিম ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় ২০০৭ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তবে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ না করেই তিনি ২০০৮ সালে ওই রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন।
রুল শুনানি শেষে ওই বছরই বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আসামিকে (ওয়াবদুল করিম) বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। নিয়মানুসারে মামলার মূল নথিটি উচ্চ আদালত থেকে বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর সেই নথিপত্র গ্রহণ করেন বিচারিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এরপর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর অগ্রসর হয়নি। মামলার মূল নথি খুঁজে না পাওয়ায় বর্তমানে ‘মামলা ও আসামিদের সর্বশেষ অবস্থা’ সম্পর্কে কেউই বলতে পারছেন না। এমনকি যোগাযোগ করা হলেও ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধাররাও এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি। যুগান্তরের অনুসন্ধানে মামলার নথি গায়েবের চাঞ্চল্যকর তথ্যের বিস্তারিত উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে উচ্চ আদালতে নিয়োজিত দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলাটির (রিটের) প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-কোনো আসামি পলাতক অবস্থায় হাইকোর্টে রিট করতে পারবেন না। তাকে (আসামি) যদি রিট করতে হয় বা রায় চ্যালেঞ্জ করতে হয়, তাহলে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এরপর নিয়মিতভাবে রায় চ্যালেঞ্জ করতে হবে। পলাতক অবস্থায় রিট করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা যাবে না বা রায় বাতিল চাওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, উনি (ওবায়দুল করিম) হাইকোর্টে এসেছিলেন তার মামলার রায় বাতিল চেয়ে। হাইকোর্ট ডিভিশন তা স্থগিতাদেশ দেন। এরপর দুদক আপিল করে। আপিল বিভাগ বলেছেন, পলাতক অবস্থায় রায় বাতিল চাওয়া যাবে না। আপিল বিভাগ তাকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশনা দেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগের আদেশের পর বিচারিক আদালতে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন কি না, তা জানা নেই।’
জানতে চাইলে বিচারিক আদালতে নিয়োজিত দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর যুগান্তরকে বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এই মামলার নথিটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার নথি বের করে দেওয়ার জন্য আগের পেশকারকে বলা হয়েছে। মূল নথি পাওয়া গেলে মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা যেত।’
জানতে চাইলে বিশেষ জজ আদালত-১-এর পেশকার (বেঞ্চ সহকারী) রাজীব দে যুগান্তরকে বলেন, ‘এ মামলার নথি আপাতত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এ মামলায় কোনো আসামি আত্মসমর্পণ করেছেন কি না, অথবা এ মামলাটি সর্বশেষ কী অবস্থায় আছে, তা বলা যাচ্ছে না।’
এদিকে এ ব্যাপারে জানতে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সোলায়মান করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম কোনো জবাব দেননি। অপরদিকে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় এমডি সোলায়মান করিম অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সামনে আনেন। কিন্তু আলোচ্য বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
অর্থ আত্মসাতের মামলা ও রায় : ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মতিঝিল থানায় মামলাটি করা হয়। মামলার বাদী ছিলেন দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক আবদুল লতিফ। ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণার মাধ্যমে ওই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রাজধানীর মতিঝিল থানায় দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি করা হয়। তদন্ত শেষে এ মামলায় ওবায়দুল করিমসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক মো. ফিরোজ আলম এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমকে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় দোষী করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা জরিমানা এবং জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের সশ্রম করাদণ্ড দেওয়া হয়। অপর চার আসামিকে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় দোষী করে ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন-ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মো. হারুন, এসএভিপি আবুল কাশেম মাহমুদ উল্লাহ, সাবেক এভিপি মো. ফজলুর রহমান ও এভিপি একেএম নেয়ামত উল্লাহ। এছাড়া অপর আসামি একই শাখার ইও এএনএম রফিকুল ইসলামকে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় দোষী করে ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করা ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।
প্রসঙ্গত, তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের অধিকাংশ শেয়ার ছিল ওরিয়ন গ্রুপের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হওয়ায় তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয়। এরপর নতুনভাবে মূলধন ইস্যু করে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়াভিত্তিক আইসিবি পিএলসি গ্রুপের কাছে ব্যাংকটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে বর্তমান আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামকরণ করা হয়।
আত্মসমর্পণ না করেই হাইকোর্টে রিট : বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ না করেই রায় ঘোষণার পরের বছর রায় বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন আসামি ওবায়দুল করিম। তার পক্ষে ওই সময় আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (সাবেক বিচারপতি) রিট প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখেন। রুল শুনানি শেষে ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দুদকের আপিল : ২০০৯ সালে হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল (আপিল নং-৩৬/২০০৯) করে দুদক। এরপর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ বাতিল করেন। একই সঙ্গে আসামিকে (ওয়াবদুল করিম) বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। আপিল বিভাগের এই আদেশের পর উচ্চ আদালত থেকে মামলার নথিপত্র বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মামলার নথি গায়েব : ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১ পেশকার রাজীব দে যুগান্তরকে আরও বলেন, ‘এই মামলার নথিটি সেরেস্তায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের পর উচ্চ আদালত থেকে মামলার রেকর্ডপত্র বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর বিচারিক আদালতের সংশ্লিষ্ট লোকজন তা স্বাক্ষর করে জমা নেন।
এদিকে এ নিয়ে দফায় দফায় অনুসন্ধান শুরু করলে আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। নথিপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে ১২ এপ্রিল এই আদালতের (ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১) আগের পেশকার রবিউল আলমকে কল করে নথিটি কোথায় আছে, তা জানতে চান আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী জামান। জবাবে রবিউল প্রথমে একটি নির্ধারিত স্থানে নথি আছে বলে জানান। এরপর ওই নির্ধারিত স্থানে খুঁজে নথিটি পাওয়া না গেলে ফের রবিউলকে বিষয়টি জানানো হয়। জবাবে রবিউল ১৪ এপ্রিল ঢাকায় এসে খুঁজে নথিটি বের করে দেবেন বলে জামানকে জানান। আলমের সঙ্গে নথির বিষয়ে কথা বলার সময় আদালতের অপর কর্মচারীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রবিউলকে কল করার আগে আদালতের একাধিক কর্মচারী সেরেস্তায় (মামলার নথি রাখার নির্ধারিত স্থান) তন্নতন্ন করে খুঁজেও মামলার নথিটি পাননি। ১৪ এপ্রিলের পর যোগাযোগ করা হলে রবিউল বিষয়টি এড়িয়ে যান।
জানতে চাইলে বরিশাল বিশেষ জজ আদালতে কর্মরত পেশকার রবিউল আলম সোমবার (১৮ এপ্রিল) যুগান্তরকে বলেন, ‘চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এ আমার শেষ কর্মদিবস ছিল। এরপর সেখান থেকে আমি বদলীকৃত নতুন কর্মস্থলে যোগদান করি। এখানে (বরিশাল বিশেষ জজ আদালত) যোগদানের আগে আমি সেখানকার (ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১) সব নথিপত্র বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। এখন যদি কোনো মামলার নথি খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে বিষয়টি বিচারককে লিখিতভাবে জানাতে হবে। এরপর বিচারক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আদালতের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলার নথির কোনো হাত-পা নেই যে হেঁটে কোথাও গায়েব হয়ে যাবে। বাস্তবতা হলো-আমাদের মতো হাত-পাওয়ালা মানুষই নথি গায়েব করে থাকে।’ তিনি মনে করেন, ‘এই নথি কারও না কারও জিম্মায় রাখা আছে। যখন চাকরি চলে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দেবে, তখন ঠিকই নথি খুঁজে পাওয়া যাবে। এর আগে আর পাওয়া যাবে না।’