

হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম: পড়াশুনাটাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তান সালমান ফারসী বুলুর। দিনমজুর বাবা হাঁটুতে ব্যাথা পাওয়ায় ঠিকমতো কাজে যেতে পারছিলেন না। সংসারে চলছিল প্রচন্ড টানাটানি। বড় ভাই দুলু মিয়া তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। বাবার দুরবস্থা দেখে সে পড়াশুনা থামিয়ে কাঠমিস্ত্রীর কাজে যোগ দেয়ায় সংসারে কিছুটা ফিরে আসে স্বস্থি। ছোট্ট সালমান ফারসী তখন প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দিচ্ছিল। তার পড়াশুনার আগ্রহ থাকলেও আনুসাঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমসীম খাচ্ছিল পরিবারের লোকজন। এক সময় মনে হচ্ছিল পড়াশুনাটা বন্ধ করে পরিবারকে সহায়তা করতে শ্রমের কাজে যুক্ত হতে হবে। তবে মাদ্রাসায় তার ভালো ফলাফলের কারণে বড় ভাইসহ স্বশিক্ষিত বাবা-মা কখনো বাঁধা দেননি পড়াশুনায়। এই পরিস্থিতিতে সালমান ফারসী পড়াশুনার খরচ জোটাতে প্রতিবছর ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দুই থেকে তিন মাস শ্রমের কাজে চলে যেত ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। রাস্তায় মাটির কাজ ও রাজমিস্ত্রীর জোগালির কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতো তার কিছুটা পরিবারকে দিয়ে বাকিটা পড়াশুনার কাজে ব্যবহার করতো। শিক্ষকরা মাদ্রাসায় ক্লাস ফাঁকি দেয়ায় রাগারাগি করলেও শ্রমঘামের কথা কাউকে বলতো না সে। এভাবেই মেধাবী এই শিক্ষার্থী নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে দরকার অর্থের। বৃত্তবানরা এগিয়ে আসলে মেধাবী এই শিক্ষার্থীটি চালিয়ে যেতে পারবে তার লেখাপড়া।
সরজমিন মেধাবী এই শিক্ষার্থীর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পূর্ব ধণিরাম গ্রামের দিনমজুর আবেদ আলী ও গৃহিণী দুলালী বেগমের আদরের ছোট সন্তান। এক বোন ও দুভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট সে। পরিবারের সম্বল বলতে মাথা গোঁজার ৮ শতক বাড়িভিটা। প্রতিদিনের আয়ের উপর চলে সংসারটি। এমন সংসারে আলোর প্রদীপ নিয়ে জন্ম নিয়েছে সালমান ফারসী বুলু। সে পড়াশুনা করে বড়ভিটা বাজারে অবস্থিত ‘শাহবাজার এ.এইচ ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্ররাসায়’। বর্তমানে সে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং সেন্টারে পড়াশুনা করছে।
তার সাথে আলাপকালে সে জানায়, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বুঝতে পারি এসএসসিতে ফরম ফিলাপের টাকা যোগার করতে না পারলে পড়াশুনাটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের এখানে অনেক মেধাবী ছেলেকে দেখেছি পরিবারে অর্থ সংকটের কারণে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কায়িক শ্রমের কাজে লেগে পরেছে। তারা আর পড়াশুনায় ফিরে আসতে পারেনি। এজন্য নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিক্ষকদের না জানিয়ে প্রায় এক বছরের জন্য বাইরে কাজ করতে যাই। তারপর টাকা জমিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি। তবে শিক্ষকগণ আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তারা সহযোগিতা না করলে এতদূর এগুতে পারতাম না। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর এবার এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। যদিও আমার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু ঝুঁকি থাকার কারণে বিশ^বিদ্যালয় কোচিং-এ ভর্তি হয়েছি। ভালো কোন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে পরে মেডিকেলেও পরীক্ষা দেয়ার চেষ্টা করবো। আমার দরিদ্র পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।
সালমানের সহজ সরল মা দুলালী বেগম জানান, সবাই বলতেছিল ছেলে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে এখন আরো পড়াতে হবে। মাদ্রাসার শিক্ষকরা সবাই বাড়িতে এসেছিল। আমাদের কোন টাকা নাই, ওকে ভর্তির জন্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা দরকার। এই অবস্থায় বাড়িতে একটা খড়ের গাদা ছিল সেটা ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। এরপর একমাত্র গরুটাও বিক্রি করে ১২ শতক জমি বন্দক নিয়েছি। এছাড়া এখন আমাদের হাতে আর কোন কিছু নাই।
সালমানের ভাই দুলু মিয়া জানান, পরিবারে অর্থকষ্টের কারণে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত আমি পড়াশুনা করতে পেরেছি। সালমান ফারসী খুব মেধাবী। আমি পড়াশুনা করতে পারিনি। আমার ছোট ভাই যাতে পড়াশুনা করতে পারে সে ব্যাপারে যতটুকু পারছি সহযোগিতা করছি। তবে সামর্থবানরা এগিয়ে আসলে আমার ছোট ভাইটি দুশ্চিন্তা ছাড়াই পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে।
সালমানের বাবা আবেদ আলী জানান, আমার বয়স হয়েছে কাজ করতে পারি না। এখন কষ্ট করে সংসার চলছে। আগে যা ছিল সব শেষ। এখন আপনারা সহযোগিতা করলে ছেলেটা পড়তে পারবে।
শাহবাজার এ.এইচ ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্ররাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম মিয়া জানান, গত বছর আমাদের মাদরাসা থেকে সালমান ফারসী বুলু এসএসসি দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়। এবার এইচএসসি কামিল পরীক্ষায় আবারো জিপিএ-৫ পেয়ে চমকে দিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবারসহ প্রতিবেশীদের। তার রেজাল্টে আমরা খুশি। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে সে। মেধাবী এই ছেলেটির স্বপ্ন পুরণে সদাশয় সরকারসহ বৃত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার। মুটোফোন: ০১৭৯৮৯২২৯৯৬ (সালমান ফারসী বুলু)।