আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকটা অন্ধকারে ছিলেন বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এবার এই দুই ইস্যুতে দলের অবস্থান তুলে ধরতে সব নির্বাচনি আসনে গেছেন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ঈদকে কেন্দ্র করে শুভেচ্ছা বিনিময়সহ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ বিষয়ে তারা দলের হাইকমান্ডের বক্তব্যও তুলে ধরছেন।
নেতারা জানান, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। একই সঙ্গে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং এ দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিষয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নিতে নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে এও বার্তা দেওয়া হয়েছে, জুনের মধ্যে সারা দেশে দল পুনর্গঠন কাজ শেষ করা হবে। এরপর যে কোনো সময় আন্দোলনের ডাক আসবে।
সূত্র জানায়, রমজান মাসে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, বগুড়া, রংপুর, সিলেট, জামালপুর, জয়পুরহাটসহ অন্তত ৩৫ জেলার ইফতার মাহফিলে ভার্চুয়ালি অংশ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একদিনে একাধিক ইফতারে অংশ নেন তিনি। সব ইফতার মাহফিলেই দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন।
বিএনপি নেতারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে একটা অস্পষ্টতা ছিল। শেষ পর্যন্ত সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। তবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সরকারের অধীনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি আয়োজিত এক ইফতার মাহফিলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেছেন, ‘এ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যারা তাদের (বর্তমান সরকার) অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তাদের সবাইকে জাতীয় বেইমান হিসাবে খেতাব দেওয়া হবে। তারা সবাই জাতির ইতিহাসে জাতীয় বেইমান হিসাবে খেতাবপ্রাপ্ত হবেন।’
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। দাবি আদায়ে সব রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্বার আন্দোলন করা হবে। সে লক্ষ্যেই বিএনপি কাজ করছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট করে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে, যারা আন্দোলন-সংগ্রামে থাকবেন তাদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার হবে। সেই নীতি অবলম্বন করেই বিএনপির নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। আন্দোলনের জন্য দলের যে সাংগঠনিক কার্যক্রম করা দরকার তা চলছে।
সূত্র জানায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অধিকাংশ সিনিয়র নেতা এবার ঈদের দিন অথবা ঈদের আগে ও পরে তাদের নির্বাচনি আসনে গিয়েছেন। হাইকমান্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী গত জাতীয় নির্বাচনে যারা প্রার্থী ছিলেন তারাও নিজ এলাকায় যান। বিশেষ করে যারা দলে তরুণ নেতা তারা অনেকেই এবার নিজ এলাকায় গিয়েছেন। এমনকি বিএনপি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও ছিলেন এলাকামুখী। তারা তৃনমূলে নির্বাচন ও আন্দোলন ইস্যুতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পৌঁছে দেন।
গত জাতীয় নির্বাচনে খুলনা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন রকিবুল ইসলাম বকুল। তিনি যুগান্তরকে বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এখন সবার দাবি। ইফতার মাহফিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সাংগঠনিক সভায় নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে দলের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে। এতে করে নেতাকর্মীরা আরও উজ্জীবিত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জাতীয় সরকারের কনসেপ্ট দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ খুব পছন্দ করেছেন।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শরিফুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যাবে কোন পথে, ফয়সালা হবে রাজপথে’। আরও বলেছেন, ‘সরকার গঠন হলে আন্দোলনে যারা থাকবেন, পাশ করুক-ফেল করুক সবাইকে নিয়ে নির্বাচনের পরে জাতীয় সরকার হবে।’ আমার নির্বাচনি এলাকাসহ (কিশোরগঞ্জ-৬) বিভিন্ন জায়গায় ইফতার মাহফিল করেছি, সেখানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্য প্রচার করেছি। সাধারণ মানুষ তা গ্রহণও করেছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হতে হবে। এটি শুধু বিএনপির কথা নয়, দেশের আপামর জনগণের কথা। কারণ দলীয় সরকার বা আওয়ামী লীগের অধীনে যে অতীতে নির্বাচন হয়েছে তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি, মানুষ ভোট দিতে পারেনি।
ঈদের আগে ও পরে ৮ দিন নিজ নির্বাচনি এলাকায় (জামালপুর-৩) ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় জলবায়ু বিষয়ক সহ-সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দল গোছানোর কাজ তো চলছেই। এছাড়া পুরো রোজার মাসেই ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির ইফতার পার্টি ছিল। নেতাকর্মীদের এ বার্তাই দিয়েছি, দল গোছানোর পর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি আসবে। সেই কর্মসূচিতে সবাইকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। দাবি আদায়ে মাঠে থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, নেতাকর্মীরা এবার খুবই উজ্জীবিত। তারা আশাবাদী যে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেভাবে পেরেছে, আগামী নির্বাচনে সেটা পারবে না। নেতাকর্মীদের ঝুঁকি নেওয়ার সাহসটা বেড়ে গেছে। তারা মনে করছেন ভোট নেই, নির্বাচন নেই।
জোরজবরদস্তি একটা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে-এটাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এটা থেকে অবসানের জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে হবে।
বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, নিজ এলাকাসহ (ঢাকা-১৬ আসন) মহানগর উত্তরের বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানায় ইফতার মাহফিল ও কর্মিসভা হয়েছে। সেখানে দলের সিদ্ধান্তের বিষয়েও নেতাকর্মীদের অবহিত করা হয়। তারা যে কোনো আন্দোলন সফলের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। অঙ্গ-সংগঠনের মধ্যে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নীরব ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলও নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সেখানে তারা আন্দোলনের বিষয়ে তাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।