অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন, সদস্য এম এ কাসেমসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের মামলা দ্রুত সুরাহা ও তাদের বিচারের আওতায় এনে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন।
আজ সোমবার সকালে সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে ‘নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাস্টি সদস্যদের দ্রুত বিচারের দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন একথা বলেন আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ড. সুফী সাগর সামস।
তিনি বলেন, প্রায় ৩০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন ও ৪ সদস্যসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ মে দুদকের সমন্বিত ঢাকা জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির উপ পরিচালক ফরিদ উদ্দিন পাটোয়ারী বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামি করা হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য এম এ কাসেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান ও আশালয় হাউসিং অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মো. হিলালী।
লিখিত বক্তব্যে ড. সুফী সাগর সামস বলেন, মূলত আজিম-কাসেম সিন্ডিকেটের কারণেই নর্থ সাউথ পরিণত হয়েছে দুর্নীতি-অনিয়ম ও জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে। তাই এদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে অভিযুক্ত প্রত্যেকেই সমাজের প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তাই তাদের কেউ যেন আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারেন। অভিযুক্তদের বিচারের বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করতে হবে।
দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হলেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড আর্টিকেলস অনুযায়ী উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একটি দাতব্য, কল্যাণমুখী, অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকারের সুপারিশ অনুমোদনকে পাশ কাটিয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কতিপয় সদস্যের অনুমোদন-সম্মতির মাধ্যমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ডেভেলপমেন্টের নামে ৯০৯৬.৮৮ ডেসিমেল জমির ক্রয়মূল্য বাবদ ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা অতিরিক্ত অর্থ অপরাধজনকভাবে প্রদান গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের হীন উদ্দেশ্যে কম দামে জমি কেনা সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা প্রদান করেন, পরে বিক্রেতার নিকট থেকে নিজেদের লোকের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে আবার নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন এবং উক্ত এফডিআরের অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। এ ধরনের বেআইনি কার্যকলাপ সংঘটিত করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয় তথা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজেরা অন্যায়ভাবে লাভবান হয়েছেন এবং উক্ত বেআইনি কার্যক্রম করার ক্ষেত্রে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণপূর্বক কমিশন বা ঘুষের আদান প্রদান করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বিধায় ৬ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯/৪২০/১৬১/১৬৫ ক ধারা এবং ১৯৪৭ সনের ২নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা তৎসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২(৩) ধারায় দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এর মামলা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাস্টি আজিম উদ্দিন আহমেদ ও এম এ কাসেম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার সিদ্ধান্তে সাধুবাদ জানান ড. সুফী সাগর সামস। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে ট্রাস্টি সদস্য আজিজ আল কায়সার টিটুর নাম বাদ পড়ায় তিনি গভীর উষ্মা প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি অভিযুক্তদের গ্রেফতারপূর্বক দ্রুত বিচারকার্য সম্পাদনের দাবি জানান। না হলে তিনি কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় লাগামহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, সিন্ডিকেট আর জঙ্গিবাদে পর্যুদস্ত দেশের অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর জীবন। এতো বেশি অনিয়মের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মানও ক্রমেই নিম্নমুখী। নর্থ সাউথের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার পুরনো অভিযোগ তারা বারবারই অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু আদতে নর্থ সাউথ এখনো জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতার খোলস থেকে বের হতেই পারেনি। ব্লগার ও লেখক রাজীব হায়দারকে ২০১৩ সালে জঙ্গীরা কুপিয়ে হত্যা করে। সেই মামলার সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি নাফিস ইমতিয়াজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মদদে ১০ বছর পর আবারও ভর্তির সুযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও মিডিয়া সরব হওয়ায় আবার তা বাতিল করা হয়। এমন হীন কাজের মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষ ব্যক্তিদের কম মূল্যের জমি বেশি দামে ক্রয়, ডেভলাপর্স কোম্পানি থেকে কমিশন, ছাত্রদের টিউশন ফি থেকে অবৈধভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের ৯ সদস্যের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয়, এক লাখ টাকা করে সিটিং অ্যালাউন্স, অনলাইনে মিটিং করেও সমপরিমাণ অ্যালাউন্স গ্রহণ, নিয়ম ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের ৪০৮ কোটি টাকা নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংকে এফডিআর, মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে কয়েকগুণ শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম ও জঙ্গি মদদ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়েরা দুই ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আজিম উদ্দিন আহমেদ ও এম এ কাসেম সিন্ডিকেটের হাতে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই যেন জিম্মি হয়ে আছে।
দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও জঙ্গি তৈরির কারখানায় পরিণত হওয়াসহ নানা অভিযোগে বিপর্যন্ত দেশের অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্য এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি জরুরি বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।