• আজ ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেড় যুগে এমন বন্যা দেখেনি সিলেট

| নিউজ রুম এডিটর ৩:০৬ অপরাহ্ণ | মে ২১, ২০২২ লিড নিউজ, সারাদেশ, সিলেট

দেড় যুগে এমন বন্যা দেখেনি সিলেটের মানুষ। উজানের ঢল আর বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জে প্লাবিত হয়েছে নতুন এলাকা। তিন হাসপাতালে ঢুকে পড়েছে পানি। এদিকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া প্রান্তে তলিয়ে গেছে ফেরিঘাট। এতে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বগুড়ায় যমুনা, বাঙ্গালী ও করতোয়া নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সিলেট : সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সব নদ-নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। তবে এখনো সুরমা ও কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে সুরমা-কুশিয়ারার উৎসমুখ জকিগঞ্জের আমলসীদে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পানি কমলেও কমছে না বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গেল ২৪ ঘণ্টায় উভয় পয়েন্টে পানি কমেছে যথাক্রমে ১১ সেন্টিমিটার ও ১২ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া গতকাল সন্ধ্যায় কুশিয়ারার পানি শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শেওলা পয়েন্টে পানি গত ২৪ ঘণ্টায় অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে বেড়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে। ফেঞ্চুগঞ্জে পানি বেড়েছে ১৪ সেন্টিমিটার। উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসামের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় গত বুধবার বিকাল থেকে সিলেটে পানি কমতে শুরু করেছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন স্থানে পানি ৩ থেকে ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত কমেছে। গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিশ্বনাথ এলাকায় বন্যাকবলিত এলাকার অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। গত বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে জকিগঞ্জ উপজেলার আমলসীদে বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারার ত্রিমোহনায় বাঁধ ভেঙে যায়। ফলে প্রবল বেগে পানি আমলসীদ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করা শুরু করে। পানিতে আমলসীদ, বারঠাকুরী, উত্তরকুল, কাজিরপাড়া, রাড়িগ্রামসহ বারঠাকুরী ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেছে। গতকাল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জকিগঞ্জ উপজেলার বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। সিলেট নগরীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সুরমা নদীতে পানি কমায় নগরীর আবাসিক এলাকাগুলো থেকেও পানি নামতে শুরু করেছে। তবে এখনো সুরমা তীরবর্তী উপশহর, যতরপুর, সোবহানীঘাট, মাছিমপুর, ছড়ারপাড়, তেররতন, সাদিপুর, ঘাসিটুলা, শেখঘাটসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।

এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বাসা-বাড়ির পানির পাম্প ও রিজার্ভ ট্যাংক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। শহরের বাইরে উপজেলাগুলোতে মানুষের খাবার ও পানির সমস্যার সঙ্গে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করা হলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক মিটার ও লাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে ঝড়ে গাছ পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। কোথাও সঞ্চালন লাইন ছিঁড়ে পড়েছে। তাই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে মারাত্মক বেগ পেতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সুনামগঞ্জ : ভারী বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, সদর, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বন্যার কারণে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে কৃষি খাত, অবকাঠামো ও রাস্তাঘাটের।

এ ছাড়া গতকাল শান্তিগঞ্জ, দিরাই ও জগন্নাথপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। তবে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বন্যা ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। জেলাজুড়ে চরম ভোগান্তিতে আছেন সেখানকার বানভাসি মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমা জেলা সদরের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ও ছাতকে ১৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বন্যার্তদের জন্য ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে দুই শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মাঝে শুকনা ও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, জেলার বন্যার্তদের ত্রাণ হিসেবে দেওয়ার জন্য ১৪০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১২ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরের সূত্রমতে, বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১ হাজার হেক্টর ইরি ধানসহ বাদাম ও সবজি খেত। জেলার দুটি সড়কের অংশবিশেষ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এবং একটি সড়কের সেতু পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাঁচ শতাধিক খামারের মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন মৎস্য খামারিরা।

এদিকে তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কৈতক ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও জেলা বক্ষব্যাধি হাসপাতালের নিচতলায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা।

সুনামগঞ্জকে অবিলম্বে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছে জেলা বিএনপি। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর এক যৌথ সভায় এ দাবি জানানো হয়।

রাজবাড়ী : পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া প্রান্তের ফেরিঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে গেছে দৌলতদিয়া প্রান্তের ব্যস্ততম ৫ নম্বর ফেরিঘাট। দুর্ঘটনা এড়াতে এই ঘাট দিয়ে যানবাহন পারাপার বন্ধ রয়েছে। ফলে দৌলতদিয়া প্রান্তে তীব্র ঘাট সংকট শুরু হয়েছে। বর্তমানে দৌলতদিয়া প্রান্তের ৭টি ঘাটের মধ্যে ৩টি ঘাট সচল রয়েছে। ঘাট সংকটের কারণে দৌলতদিয়া প্রান্তে তীব্র ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা, বাঙ্গালী ও করতোয়া নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। ফসল রক্ষার্থে স্বেচ্ছাশ্রমে খালের মুখ বাঁধছেন কৃষক। প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে নৌঘাটগুলো। চলতি বছরে দ্বিতীয় দফায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় যমুনা এবং বাঙ্গালী নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। প্রথম দফায় গত এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পানি বেড়েছিল। অসময়ের এই পানি বেড়ে যাওয়ায় বোরো ধান, পিঁয়াজসহ নানা ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। পরে পানি কমে যায়। গত কয়েক দিন ধরেই যমুনা এবং বাঙ্গালী নদীতে পানি পুনরায় বাড়তে শুরু করেছে। ফলে যমুনা এবং বাঙ্গালী নদীর অববাহিকায় কৃষকের পাটের ফসল হুমকিতে রয়েছে।