• আজ ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নড়াইলের নীহার রঞ্জন গুপ্তের বিশাল পৈতৃকভিটা ও দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি সংস্কারের দাবি

| নিউজ রুম এডিটর ৪:১১ অপরাহ্ণ | জুন ১৮, ২০২৩ জাতীয়

উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে:নড়াইলের নীহার রঞ্জন গুপ্তের বিশাল পৈতৃকভিটা ও দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি সংস্কারের দাবি। কিরীটি রায়’ চরিত্রখ্যাত স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক ও চিকিৎসক নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯১১ সালের ৬ জুন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবার নাম সত্যরঞ্জন গুপ্ত ও মায়ের নাম লবঙ্গলতা দেবী। উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে জানান, নীহার রঞ্জন গুপ্ত গোয়েন্দা ও রহস্য কাহিনী লেখক হিসেবে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি চিকিৎসক হিসেবেও স্বনামধন্য। বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ‘কিরীটি রায়’ এর স্রষ্টা হিসেবে উপমহাদেশে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। তার পরিবার ছিল বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয়। উইকিপিডিয়াসহ (মুক্ত বিশ্বকোষ) বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে নীহার রঞ্জন সম্পর্কে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

নড়াইলের ইতনা গ্রামে নীহার রঞ্জন গুপ্তের আপনজন কেউ নেই। প্রায় ২০০ বছরের ঐহিত্যবাহী দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল বাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে ভগ্নদশায় থাকার পর ২০১৭ সালে সংস্কার করা হয়েছে। সুবিশাল নান্দনিক এই বাড়িটির নাম-‘আনন্দ অন্নদা কুটির’। প্রাচীন স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন এটি। দ্বিতলা বাড়িটিতে নিচতলায় সাতটি এবং উপরতলায় তিনটি কক্ষ রয়েছে। আর বাসভবনের সামনেই রয়েছে মন্দির। এছাড়া একটি পুকুরসহ গাছপালা রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে-উপরতলার একটি কক্ষে নীহার রঞ্জনের জন্ম হয়। বাবা সত্যরঞ্জন গুপ্ত ও মা লবঙ্গলতা দেবীর ঘরে বেড়ে ওঠা সেই কিশোরই দেশ-বিদেশে স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিত্ব।

বরেণ্য ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্তের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সরকারি ভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আমরা ভুলতে বসেছি নীহার রঞ্জনকে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানেন না, নীহার রঞ্জন গুপ্ত কে? তিনি কি ছিলেন? জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর সময় সরকারি উদ্যোগে এখানে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না।বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, চাকরিজীবী বাবা সত্যরঞ্জন গুপ্তের বিভিন্ন কর্মস্থলে অবস্থানকালে নীহার রঞ্জন গাইবান্ধা হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলে পড়ালেখা করেন। ১৯৩০ সালে ভারতের কোন্ননগর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ডাক্তারি পড়ার জন্য কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি বিদ্যায় কৃতকার্য হন। এরপর লন্ডন থেকে চর্মরোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তার বড় বোন বিষাক্ত পোকার কামড়ে মারা যাওয়ায় এ চিকিৎসার স্বপ্ন দেখেন এবং পরবর্তীতে সফলও হন।

কর্মজীবন: ডাক্তারি পাস করে বেশ কিছুদিন নিজস্ব ভাবে প্রাক্টিস করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হন। তিনি মেজর পদেও উন্নীত হন। চাকুরি সূত্রে চট্টগ্রাম, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), মিশর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে ঘুরে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এক সময় চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারি শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কলকাতায় বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে পরিবারসহ স্থায়ী ভাবে কলকাতায় বসবাস করেন।

সাহিত্য কর্ম: নীহাররঞ্জন গুপ্তের সাহিত্যে হাতে খড়ি শৈশব থেকেই। একসময় শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ গ্রহণসহ তার স্বাক্ষর বা অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেন তিনি। ১৬ মতান্তরে ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘রাজকুমার’ মতান্তরে ‘রাজকুমারী’ প্রকাশিত হয়। নীহার রঞ্জন গুপ্ত পেশায় চিকিৎসক হলেও মানব-মানবীর হৃদয়ের কথা তুলে ধরেছেন সুচারু ভাবে। ‘রহস্য’ উপন্যাস লেখায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। লন্ডনে অবস্থানকালীন সময়ে গোয়েন্দা গল্প রচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। ভারতে এসে প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস ‘কালোভ্রমর’ রচনা করেন। এতে গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে ‘কিরীটি রায়’কে সংযোজন করেন, যা বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি। পরবর্তীতে ‘কিরীটি রায়’ চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে বাঙালি পাঠকমহলে। তিনি বাংলা সাহিত্যে রহস্য কাহিনী রচনার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্ব›দ্বী লেখক ছিলেন। কেবলমাত্র রহস্য উপন্যাস নয়, তার সামাজিক উপন্যাসগুলোও সুখপাঠ্য। যা পাঠক হৃদয় আকৃষ্ট করে এখনো। এ পর্যন্ত অন্তত ৪৫টি উপন্যাসকে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়ণ করা হয়েছে। এছাড়া শিশুদের উপযোগী সাহিত্য পত্রিকা ‘সবুজ সাহিত্য’ এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

উপন্যাসের সংখ্যা: নীহার রঞ্জন গুপ্তের উপন্যাসের সংখ্যা দুইশতেরও বেশি। এর মধ্যে প্রকাশিত উপন্যাসগুলো-‘মঙ্গলসূত্র’, ‘উর্বশী সন্ধ্যা’, ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘অমৃত পাত্রখানি’, ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘অশান্ত ঘূর্ণি’, ‘মধুমতি থেকে ভাগীরতী’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘অহল্যাঘুম’, ‘ঝড়’, ‘সেই মরু প্রান্তে’, ‘অপারেশন’, ‘ধূসর গোধূলী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘কলোভ্রমর, ‘ছিন্নপত্র’, ‘কালোহাত’, ‘ঘুম নেই’, ‘পদাবলী কীর্তন’, ‘লালু ভুলু’, ‘কলঙ্ককথা’, ‘হাসপাতাল’, ‘কজললতা’, ‘অস্থি ভাগীরথী তীরে’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘সূর্য তপস্যা’, ‘মায়ামৃগ’, ‘ময়ূর মহল’, ‘বাদশা’, ‘রত্রি নিশীথে’, ‘কনকপ্রদীপ’, ‘মেঘকালো’, ‘কাগজের ফুল’, ‘নিরালাপ্রহর’, ‘রাতের গাড়ী’, ‘কন্যাকেশবতী’, ‘নীলতারা’, ‘নূপুর’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মধুমিতা’, ‘মুখোশ’, ‘রাতের রজনী গন্ধা’ ও ‘কিশোর সাহিত্য সমগ্র’ উল্লেখযোগ্য। চিকিৎসক হিসেবে অতি কর্মচঞ্চল জীবনযাপনের মধ্যেও নীহার রঞ্জন রেখে গেছেন অসংখ্য সাহিত্য সৃষ্টি। যা আপন সত্তার ভাস্কর।

নীহার রঞ্জনের অন্তত ৪৫টি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘লালুভুলু’, ‘হাসপাতাল’, ‘মেঘ কালো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘নূপুর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘বাদশা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মায়ামৃগ’, ‘কাজললতা’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি। এই চলচ্চিত্রায়িত উপন্যাসগুলো আমাদের চলচ্চিত্র জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। তার কালজয়ী উপন্যাস ‘লালুভুলু’ পাঁচটি ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি বাংলাদেশেও চিত্রায়িত হয় এবং দর্শকদের কাছে প্রশংসা অর্জন করে।

নীহার রঞ্জনের অনেক উপন্যাস থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে। বিশেষ করে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘উল্কা’ থিয়েটারের দর্শকদের আকৃষ্ট করে। নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এদিকে ইতনা গ্রামের সন্তান কবি চিত্রশিল্পী ও গবেষক এস এম আলী আজগর রাজা বলেন, নীহার রঞ্জন গুপ্তের এক একরের বিশাল পৈতৃকভিটা ও দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি সংস্কার এবং সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আরো যত্নশীল হবে-এমন প্রত্যাশা নড়াইলবাসীর। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নীহার রঞ্জন গুপ্তের স্মৃতি রক্ষার্থে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে নীহার রঞ্জন গুপ্তকে জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি দেয়া, নীহার রঞ্জনের উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখা প্রকাশ করা, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত, ইতনা গ্রামে জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন এবং একুশে পদক প্রদান।