• আজ ৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পেশাভিত্তিক সংগঠন ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা: জাতীয়তাবাদী তাঁতীদলের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা

| Peoples News ৫:২৬ অপরাহ্ণ | ডিসেম্বর ১৮, ২০২৫ গণমাধ্যম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে পেশাভিত্তিক ও সহযোগী সংগঠনগুলোর ভূমিকা দীর্ঘদিনের। মূল রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও কর্মসূচি নির্দিষ্ট শ্রেণি বা পেশার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এসব সংগঠন কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে শ্রমনির্ভর ও উৎপাদনমুখী খাতের সঙ্গে যুক্ত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের গুরুত্ব আরও বেশি। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদী তাঁতীদলের সাম্প্রতিক সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা অনুপ্রেরণামূলক এবং বিশ্লেষণযোগ্য এক উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

তাঁতশিল্প বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। লক্ষাধিক পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘদিন ধরে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাত্রা করা তাঁতশিল্প এখনো জীবন্ত ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনা বহন করে। কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব এবং নীতিগত সহায়তার ঘাটি থাকা সত্ত্বেও তাঁতীরা নিজেদের শ্রম ও দক্ষতায় দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে অবিচল।

এই বাস্তবতার মধ্যে পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখে। জাতীয়তাবাদী তাঁতীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সহযোগী সংগঠন হিসেবে মূলত তাঁতী শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও তাঁত মালিকদের সমস্যা জাতীয় রাজনীতির আলোচনায় আনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

২০১৯ সালে আহ্বায়ক কমিটি- আবুল কালাম আজাদ ও হাজী মজিবুর রহমান নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় সংগঠনটি সাংগঠনিকভাবে সীমিত ও দুর্বল অবস্থায় ছিল। জেলা ও মহানগর পর্যায়ে সক্রিয় কমিটির সংখ্যা মাত্র ১৪-১৫টি। তৃণমূল পর্যায়ে অনেক এলাকায় সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও কেন্দ্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা কার্যক্রমকে সীমিত করেছিল।

এই প্রেক্ষাপটে আহ্বায়ক কমিটি গঠন একটি পুনর্গঠনমূলক এবং ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে দেখা যায়। কমিটি স্থবিরতা ভেঙে কার্যকর কাঠামো দাঁড় করানোর পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

২০১৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে সাংগঠনিক বিস্তার উল্লেখযোগ্য। সংগঠনটি বর্তমানে দাবি করছে- ১০০ শতাংশ জেলা ও মহানগর পর্যায়ে কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; উপজেলা, পৌরসভা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তৃত হয়েছে; সারাদেশব্যাপী একটি সক্রিয় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে।

এই সাংগঠনিক অর্জন রাজনৈতিকভাবে চাপপূর্ণ পরিবেশেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী উপস্থিতি গড়ে তোলা যেকোনো সহযোগী সংগঠনের জন্য প্রশংসনীয়।

সংগঠন পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আহ্বায়ক কমিটি ‘চাঁদাবাজি ও হয়রানি মুক্ত’ নীতিমূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে। এটি নেতাকর্মীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অংশগ্রহণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

নিরপেক্ষভাবে দেখা যায়, একটি পেশাভিত্তিক সংগঠনের জন্য নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য পরিবেশে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁতী সমাজ অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল হলেও এই ধরনের সাংগঠনিক সংস্কার তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সহজ ও কার্যকর করে।

২০১৯-২০২৫ সময়কাল বাংলাদেশের বিরোধী দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জপূর্ণ হলেও, জাতীয়তাবাদী তাঁতীদল এই প্রতিকূলতার মধ্যেও সংহতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। নেতাকর্মীরা মামলা, গ্রেপ্তার, নজরদারি ও প্রশাসনিক চাপের মধ্যেও সংগঠন পরিচালনা এবং সাংগঠনিক কাঠামোকে দৃঢ় রাখতে অবিরত কাজ করেছেন। এই দৃঢ়তা নেতৃত্বের স্থায়িত্ব এবং সংগঠনের সক্ষমতার প্রমাণ।

বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ ও সদস্য সচিব হাজী মজিবুর রহমানকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতির দাবি জানাচ্ছেন। এটি প্রমাণ করে, দীর্ঘ সময় ধরে সংগঠনের পুনর্গঠন এবং কার্যক্রম পরিচালনার স্বীকৃতি দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া ইতিবাচকভাবে চলছে।

নিরপেক্ষভাবে দেখা যায়, আহ্বায়ক কমিটির দীর্ঘ সময় কাজ করা চ্যালেঞ্জপূর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন এবং নেতৃত্বের স্বীকৃতি সংগঠনের কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করেছে। নেতৃত্বের পদোন্নতি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও ভারসাম্য বজায় রেখে সম্পন্ন হলে, এটি পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলোর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয়তাবাদী তাঁতীদলের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের পেশাভিত্তিক রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, সহযোগী সংগঠন কেবল মূল দলের কর্মসূচির বাহক নয়; বরং এটি পেশাভিত্তিক বাস্তব সমস্যাগুলোকে কার্যকরভাবে তুলে ধরতে সক্ষম।

তাঁতী সমাজের বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলো- কাঁচামালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, ন্যায্য বাজারব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা- রাজনৈতিক দাবিতে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংগঠন ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। এই অভিজ্ঞতা দেখায়, পেশাভিত্তিক সংগঠন মূল রাজনৈতিক দল ও সদস্যদের মধ্যে শক্তিশালী সংযোগ তৈরি করতে পারে।

জাতীয়তাবাদী তাঁতীদলের ২০১৯-২০২৫ সময়কাল মূলত একটি পুনর্গঠনপর্ব। সীমিত সাংগঠনিক উপস্থিতি থেকে সারাদেশব্যাপী বিস্তৃত কাঠামো গড়ে তোলা- প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে, একটি উল্লেখযোগ্য এবং ইতিবাচক অভিজ্ঞতা।

এই অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত মূল্যায়ন নির্ভর করবে: পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্ব গঠন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও ভারসাম্য, এবং তাঁতী সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলোকে কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপ দেওয়ার সক্ষমতার ওপর।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলো যদি কেবল আনুগত্যের কাঠামোতে সীমাবদ্ধ না থেকে দাবি-ভিত্তিক রাজনীতির দিকে এগোতে পারে, তবে তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ইতিবাচক হবে। জাতীয়তাবাদী তাঁতীদলের অভিজ্ঞতা সেই সম্ভাবনার সূচনা, যা ভবিষ্যতে আরও গভীর ও সমালোচনামূলক মূল্যায়নের দাবিদার।

ডঃ এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক