আজিজুল ইসলাম বারী, লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ নব্যদের ভিড়ে নিরবে হারিয়ে যাচ্ছেন লালমনিরহাটের তৃনমুলের আওয়ামীলীগে এক সময়ের দাপুটে নেতারা। দুর্দিনের হাতিয়ার ত্যাগীরা সুদিনে অযত্ন আর অবহেলায় হারাতে বসেছেন জীবন প্রদীপ।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ তথা পরবর্তি সময়ে নানা কারনে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত উত্তরাঞ্চলের ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা জেলা লালমনিরহাট। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দখলে চলে যায় জেলার রাজনীতি। সেই সময় কর্মী সংকটে বেশ বেকায়দায় পড়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ। জিয়া পরবর্তি টানা ৩০ বছরের অধিক সময় জাতীয় পার্টির একক আধিপত্তে ঘেরা ছিল জেলার রাজনৈতিক অঙ্গন। বিশেষ করে লালমনিরহাট ২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনটি টানা ৩৬ বছর জাপা নেতা প্রায়ত মজিবর রহমান এমপি’র দখলে ছিল।
সেই সময় হাতে গোনা কিছু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নেতাকর্মী আওয়ামীলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। কর্মী কম থাকায় নানান নির্যাতন নিপীড়ন সহায় করে দলীয় কর্মসুচি সফল করেছিলেন তারা। নিজের জমি আর গোলার ধান পাট বিক্রি করে রাজনীতি করা এসব নেতাকর্মী বর্তমানে নিদারুন অর্থকষ্টে ভুগলেও কেউ খবর নিচ্ছেন না বলে তাদের বিস্তার অভিযোগ।
প্রবীণ এসব নেতাকর্মীরা জানান, তৎকালিন সময় জাতীয় পার্টি আর বিএনপি’র চাপে চরম নির্যাতিত হয়েও নৌকার সমর্থনে কাজ করেছেন। দলের আদর্শ থেকে বিচ্চ্যুত হননি তারা। শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ করার কারনে জীবনের মুল্যবান সময় জেলখানা আর বাড়ি ছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সব থেকে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এরশাদ হটাও আন্দোলনে। জাপার ঘাঁটিতে নৌকা ভিড়াতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে তাদের। কোন একদিন আওয়ামীলীগের সুদিন এলে মুল্যায়িত হবেন সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবারকে শান্তনা দিতেন আজকের প্রবীণ নেতাকর্মীরা।
আজ আওয়ামীলীগের জয়জয়কার ও সুদিন ফিরে আসায় কর্মীর অভাব নেই দলটিতে। এক সময়ের কঠোর বিরোধিরাও আওয়ামীলীগে চেপে বসে বড় বড় পদ দখলে নিয়েছেন। তাদের ভিড়ে অবহেলিত সেই সময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অসুস্থ হয়ে বিছানায় মৃত্যুর প্রহর গুনলেও কোন নেতাকর্মী তাদের খবর রাখেন না। চিকিৎসার সহায়তার আবেদন করেও সুফল পাননি কেউ কেউ। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে নিরবে বিছানায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন অনেকে।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের আব্দুল গফ্ফার। যাকে আওয়ামীলীগ গফ্ফার নামে সবাই চিনতেন। এরশাদ হটাও আন্দোলনের সময় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে অনুপ্রবেশকারীদের ভিড়ে ডুবে গেছে তার নাম ডাক। বাধক্য তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ফিরেও তাকায়নি কেউ। নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসার সহায়তা চেয়ে সমাজসেবা মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেও সহায়তা মিলেনি তার। শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের চাকুরীর জন্য হন্নে হয়ে ঘুরেও চাকুরী যোগাতে পারেননি।
তিনি বলেন, কর্মী কম থাকায় তখন নৌকার মিছিল বের করলে সবাই অট্ট হাসি দিতো। হামলা চালাতো জাতীয় পার্টি আর বিএনপি’র ক্যাডাররা। আজ সেই হামলাকারীরাই দলের বড় বড় পদে বসেছেন। তাদের কাছে গেলে সহায়তা তো দুরের কথা সম্মান টুকুও মিলে না। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য হিসেবে রাখলেও কেউ খবর টুকুও নিচ্ছেন না। মরে গেছি না কি জীবিত আছি?
একই অবস্থা তার সহযোদ্ধা ইশা খাঁন বিদা’র। নিজ দলে কর্মী বাড়াতে পকেটের টাকায় হাট বাজার মাঠ ঘাট চায়ের দোকানে ক্যাম্পেইন করতেন। তিনিও আজ প্যারাইলাইজ হয়ে বাধক্যে শয্যাশায়ি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা স্ত্রী মরিয়ম সুলতানার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে একাধিকবার আবেদন করেছেন। ছেলেকে কয়েক দফায় সমাজসেবা মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছেন। সবাই চিকিৎসা সহায়তার চেক পেলেও প্রবীণ আওয়ামী নেতার স্ত্রীর চিকিৎসায় একটি টাকাও সহায়তা মিলেনি। উল্টো পরিবারের কাছে লজ্বিত হয়েছেন প্রবীণ এ নেতা।
অবশেষে শুন্য হাতে ফিরে চাষাবাদের জমিটুকু বন্দক রেখে মায়ের হার্টে রিং স্থাপন করে নিয়েছি। বলেন তার ছেলে শাওন খাঁন রাজিব।
১৯৮৭-৯৭ পর্যন্ত আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। যিনি এরশাদ হটাও আন্দোলনে বাড়ি ছেড়ে বাঁশঝাড়ে আত্নগোপনে রাত কাটিয়েছেন। জুলুম মামলা হামলার শিকার হয়েছেন। আজ তিনিও আর্থিক ভাবে পঙ্গু। তারও কোন খবর রাখেন না বর্তমান নেতাকর্মীরা। তিনি বলেন, এরশাদ হটাও আন্দোলনে একটি রাতও বাড়িতে ঘুমাতে পারিনি। মশার কামড়ে শরীরে ঘা হয়েছিল। সেই সময়ের জাতীয় পার্টির ক্যাডারা আজ আওয়ামীলীগের মন্ত্রী এমপিদের চার পাশে বসে থাকেন। আমাদের কথা শোনার সময়ও তো তাদের নেই।
১৯৯০-৯৭ পর্যন্ত আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক মাহবুবার রহমান ফারুক বলেন, এরশাদ হটাও আন্দোলন আর বিএনপি বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহন করায় একটি রাতও বাড়িতে থাকতে পারিনি। একেক দিন একেক আত্নীয় বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়েছি। আজকে দলে অনেক লোক। কিন্তু ত্যাগীরা নেই। সময় এসেছে তাদের খুজে বের করে কৃতজ্ঞতা জানানো। তবে তারা মরে গেলেও শান্তি পাবেন।
১৯৮৫ – ৯০ পর্যন্ত আদিতমারী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং ৯০-৯৭ সাল পর্যন্ত উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্পাদক বাবু নীল কমলও সুদিনে বঞ্চিত। তিনি ১৯৮৮ সালে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামুড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের জনসভায় বিশেষ অতিথি ও আয়োজক ছিলেন। আজ দলের সুদিনে তিনিও বঞ্চিত। গেল ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক চেয়েও বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালে নামুড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভা করেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সেই সময় এরশাদ হটাও আন্দোলনে জেলা উপজেলার নেতারা কারাবন্দি থাকায় সভানেত্রীর জনসভায় যুবলীগের সভাপতি হিসেবে আমি আয়োজক ছিলাম। সভানেত্রী প্রধান অতিথির বক্তব্য রেখেছিলেন। আমি বিশেষ অতিথির। ওই দিন নেত্রী বলেছিলেন, “দেশের মানুষ এক সময় আমাদেরকে(আ’লীগ) ক্ষমতায় বসাবে। তখন কোন সংকট থাকবে না। কষ্ট হলেও দলকে গুছিয়ে নাও”। নেত্রীর নির্দেশে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আজ নেত্রীর কথা বাস্তব হয়েছে, মানুষ ঠিকই আমাদের দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। সুদিনে হাইব্রিডদের ভাগ্য ফিরলেও ভয়াল দিনের ত্যাগীরা আজও অবহেলিত।
শুধু আব্দুল গফ্ফার, ইশাখাঁন বিদা বা আবুল কালামই নয়। গোটা জেলার তথা সারা দেশের ওই সময়ের অনেক ত্যাগী ও প্রতিষ্ঠাতা আওয়ামী নেতা আজকে দলের সুদিনে বঞ্চিত। কেউ কেউ মানবেতর জীবন যাপন করলেও খবর রাখছেন না বর্তমান পদে থাকা নেতাকর্মীরা। দুর্দিনে যারা পরিশ্রম করেছেন। যাদের ত্যাগে আজকের প্রতিষ্ঠিত আওয়ামীলীগ। সুদিনে ওই সকল নেতাকর্মীকে মুল্যায়ন করবে এমনটাই প্রত্যাশা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।