

রাফি হোসেন, কুবি:ঈদের সকালটা এখনো ঠিক আগের মতোই আছে। ভোরের আকাশে হালকা রঙের রেখা ধরে সূর্যোদয়, মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসা তাকবিরের ধ্বনি, ঘরে ঘরে শুরু হওয়া কোরবানির আয়োজন ঘিরে হাঁসফাঁস, পাল্টায়নি যেন কিছুই। বাড়ির উঠোনে বাঁধা কোরবানির গরুর গলায় ঘণ্টি বাঁজা আর শিশুদের দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করা—“ঈদ! ঈদ!!” আছে, সবই আছে।
আর এসবকিছু যার উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে তিনি হলেন ‘বাবা’। যার হাত ধরেই প্রতিটি সন্তানের পরিপূর্ণ হয়ে উঠে ঈদের দিন। যার ছোঁয়ায় ঈদের ক’দিন আগে থেকেই বদলে যায় বাড়ির প্রতিটি আঙিনা।
তবে ঈদ ঘিরে বাবার সেই উচ্ছ্বাস এখন অনেকের জন্য শুধুই স্মৃতি। বাবার অনুপস্থিতিতে কেমন কাটে তাদের ঈদ? বাবা ছাড়া ঈদের সকাল! সেটা যেন এক আবছা কুয়াশায় ঢাকা মেঘের চাদর, হৃদয়ে গাঁথা এক গভীর অনুভব, যেখানে কোরবানির গন্ধে মিশে আছে একরাশ হতাশা, এক ফালি দীর্ঘশ্বাস আর চিরকালীন শূন্যতা।
ইয়ান মার্টেলের ভাষায়, “বাবাকে হারানোর মানে হলো মাথার ওপরের ছাদ হারিয়ে ফেলা।” এই অনুভূতি, এই শূন্যতার কথা বলেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা এমন হতভাগ্য কিছু সন্তান—যাদের ঈদ এখন আর আগের মতো উৎসব নয় বরং এক ধরনের নিঃশব্দ অপেক্ষা, একরাশ হাহাকার।
ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২২-২৩ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার বলেন, ‘আব্বু তুমি কেমন আছো? তুমি মনে করছো তোমাকে আমি ভুলে গেছি? কিন্তু না। এই ঈদ এর দিনে তোমাকে প্রতিটা মুহূর্ত আরো বেশি মনে পড়ছে। সকাল বেলা সাদা পাঞ্জাবী, টুপি, জায়নামাজ দিয়ে তোমাকে রেডি করে দিতাম। ঈদটা তোমাকে ছাড়া একদম অপূর্ণ আব্বু!’
অর্থনীতি বিভাগের ২০২২-২৩ বর্ষের শিক্ষার্থী তাকিব হাসান বলেন, ‘মুসলিম জাতির জন্য ইদ হচ্ছে প্রধান উৎসব। পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাসিখুশি ভাবে ইদ পালন করে। কিন্তু এই সময় বেশি মনে পড়ে প্রিয়জনদের, যারা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, আর প্রতিবার ইদ আসলে আমি আমার বাবাকে মিস করি, ৭ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি আর বড় ভাই মিলে ঈদ করি। কিন্তু বাবাকে ছাড়া ঈদ করা তেমন তেমন আনন্দ পায় না, তখন বাবার অনুপস্থিতিকে সবচেয়ে বেশি মিস করি।’
ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা সাদিয়া জাহাম প্রমী বলেন, ‘বাবা—এই ছোট্ট শব্দটির সাথে এতটাই আবেগ, মায়া আর ভালোবাসা জড়ানো যে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ২০২৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর থেকে আমার বাবা নেই, আর বাবাকে ছাড়াই দুটি ঈদ পার করেছি কেবল আনন্দহীন শূন্যতায়। আমার ঈদকে মূল উপকরণ বাবা-মা; তাদের কেউ একজন না থাকলে ঈদ যেন অর্থহীন। বাবার সাথে কাটানো ঈদের স্মৃতিগুলো আজও মানসপটে স্পষ্ট—খুব ভোরে মসজিদে যাওয়া, ফিরে এসে সবার একসাথে হাসিখুশি খাওয়া-দাওয়া।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইদানীং বাবার কণ্ঠ শোনার, আদর পাওয়ার, এমনকি শুধু তাকে দু’চোখ ভরে দেখার এক তীব্র ‘তৃষ্ণা’ মনকে ব্যাকুল করে তোলে। এই ‘তৃষ্ণা’ এতটাই ভয়াবহ ও বিষাক্ত যে কোনো কিছু দিয়েই এটাকে স্বাভাবিক করা যায় না। মনে হয়, একবার যদি বাবার দেখা পেতাম, কণ্ঠ শুনতে পেতাম, একটু জড়িয়ে ধরতে পারতাম, তাহলে সব অস্থিরতা কেটে যেত, আর জমে থাকা কান্না বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসত। কিন্তু পরিযায়ী পাখির মতো বাবা তো আর ফিরে আসেন না। ঈদের মতো সুন্দর দিনেও জীবনের এই শূন্য মুহূর্তগুলো এত বেদনাদায়ক কেন লাগে, কে জানে! পরিশেষে, পৃথিবীর সব বাবা ভালো থাকুক, যারা নিঃস্বার্থভাবে সন্তানদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন।’
আইন বিভাগের ২০২২-২৩ বর্ষের শিক্ষার্থী আব্রাম ফাহাদ বলেন, ‘বাবাকে ছাড়া দু’টি কোরবানির ঈদ পালন করলাম। গরু জবাই হলো, গোস্ত খাওয়া হলো কিন্তু কোথায় যেন খালি খালি লাগছিলো,কি নেই? ঘরে ছিল না আগের মতো উত্তেজনা, কোরবানির ঈদে প্রধান উত্তেজনা কাজ করে গরু কেনা নিয়ে, কিন্তু আমাদের ঘরে সেই উত্তেজনা ছিল না, গরু কিনতে আর বাজারে যাওয়া হলো না, ঈদের দিন সকালে গরু কে গোসল করানো নিয়ে কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি শুনলাম না, এ যেন এক নীরব-নিস্তব্ধ ঈদ উদযাপন, প্রতি কোরবানির ঈদ আসলে মনে হয় বাবার অনুপস্থিতি যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে।’
আইন বিভাগের একই বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী রাফিউল হক বলেন, ‘আসলে অনূভুতি কিছুই ফিল হয়না আরকি, এসব নামের ঈদ, জাস্ট আসে যায়, একটা সময় কত আনন্দ ছিল, আব্বা থাকলে ঈদের ফিল টাই অন্যরকম আরকি, সব কিছুতে একটা অন্য ধরনের প্রাণ থাকে, সব কাজে একটা আলাদা জোর থাকে, মনে আলাদা ধরণের আনন্দ থাকে। মূল কথা এখনকার ঈদ প্রাণহীন, জাস্ট করতে হয় বলে করি, মনে কোনো আনন্দ নেই।’
প্রতিটি পরিবারেই ঈদের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকেন একজন—বাবা। তিনি থাকলে ঈদের সকালে শুধু খাবারের গন্ধ নয়, ছড়িয়ে পড়ে প্রশান্তি, ভালোবাসা, নির্ভরতা। আর তিনি না থাকলে? তখন ঈদের সাদা জামার ভাঁজে লুকিয়ে থাকে অনুচ্চারিত বিষণ্নতা। কোরবানির ঈদ আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয় ঠিকই, কিন্তু সেই শিক্ষা সবচেয়ে গভীরভাবে বোঝে তারা—যাদের ঈদের সকাল ভাঙে বাবাহীন নিঃসঙ্গতায়।