• আজ ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাঠ পর্যায়ে ভোটের প্রস্তুতিতে নামছে আওয়ামী লীগ

| নিউজ রুম এডিটর ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ | ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ, রাজনীতি, লিড নিউজ

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দল ও সহযোগী সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত করার পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে দলটি। গতি পাচ্ছে ইশতেহার তৈরির কাজও।

নির্বাচনকে সামনে রেখে অপপ্রচারের জবাব দিতে ও উন্নয়ন প্রচারে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এছাড়া দলীয় প্রার্থী বাছাই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলেও বিভিন্ন জরিপ এবং তথ্য সংগ্রহের মাধমে ভেতরে ভেতরে এ কাজ এগিয়ে রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অন্যদিকে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও সদস্য নবায়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনেও জোর দেওয়া হচ্ছে। ভোটের আগে জোটের মেরুকরণেও নজর রাখছেন দলটির হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ও দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্লেন (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের সঙ্গে বৃহস্পতিবার বিকালে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় নির্বাচনের পক্ষে। ইতোমধ্যে আমাদের নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের দলের নেতারা সুশীল সমাজ, যুবক-তরুণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষদের কথা শুনছেন। তারা দেশটাকে কীভাবে দেখতে চায়, সেই তথ্যগুলো আমরা নিচ্ছি। এগুলো আমাদের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকবে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনগণের কাছে সত্য তুলে ধরব। একই সঙ্গে আমাদের সময়ে যে উন্নয়নগুলো হয়েছে সেগুলো তৃণমূলে গিয়ে মানুষকে জানাব। বিএনপি যে কখনো গণতন্ত্র ও নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, তার প্রমাণগুলো আমরা তুলে ধরব।

তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল পর্যন্ত দল গোছানোর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ চলছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমাদের আট বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের সদস্যরা মাঠে নামবেন। দলের মধ্যে বিশেষ করে তৃণমূলে কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। জাতীয় পর্যায়ে এই সমস্যা খুব একটা নেই। আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীদের বোঝাব। নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকলে তা মিটিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ করব। দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এমপি-মন্ত্রী-নেতা যারাই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাচ্ছে বা যাবে তাদের বিষয়গুলো নোট করা হচ্ছে। আগামীতে সময়মতো তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে, এটা ধরে নিয়েই ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। মঙ্গলবার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সর্বশেষ সভায় দলকে নির্বাচনিমুখী করতে বেশি কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। করোনা সংক্রমণ কমার সঙ্গে সঙ্গে দলের নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচার এবং সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। দলের কার্যক্রম গতিশীল করতে ২০২০ সালের অক্টোবরে দেশের আট বিভাগের জন্য আটটি সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছিল। বৈঠকে এই কমিটিগুলোকে আরও তৎপর হওয়ার তাগিদ দেন দলীয় প্রধান। এ সময় নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংগঠনকে গড়ে তুলতে হবে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, যখনই আমরা প্রস্তুতি শুরু করি তখনই করোনার নতুন নতুন ঢেউ এসে পড়ে। করোনা সংক্রমণ রোধে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি বিধিনিষেধ রয়েছে। আমাদের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেই রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো আবার দ্রুতগতিতে করার চেষ্টা করব।

ইশতেহার তৈরি : গত বছরের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইশতেহার আপডেট করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে নির্বাচনি প্রস্তুতির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেমিনারের মাধ্যমে নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তযোগ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন বিষয়ের সুপারিশ বা আপডেট করার জন্য উপকমিটিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের কয়েকটি উপকমিটি কাজও শুরু করেছিল। বেশ কয়েকটি সেমিনারের আয়োজনও করেছিল তারা। তবে করোনার কারণে এই কাজেও কিছুটা স্থবিরতা নেমে আসে।

দলের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় মঙ্গলবার আবারও ইশতেহার আপডেটের কাজে গতি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, নির্বাচনের আগে ইশতেহার তৈরির জন্য আমাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা কমিটি করে দেবেন। তারা দেশের বিভিন্ন সেক্টরের কথা বলে, বিশেষজ্ঞদের মতামত দিয়ে খসড়া তৈরি করবেন। উপকমিটিগুলো তাদের সভা-সেমিনারের মাধ্যমে পাওয়া প্রস্তাবনাগুলো জমা দেবেন। সেখান থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী প্রস্তাবনাগুলো নেওয়া হবে।

নির্বাচনের আগে তৃণমূল পর্যন্ত দল গোছানো : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই তৃণমূল গোছানোর কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। করোনা সংক্রমণ কমে গেলে এবং ২১ তারিখের পরে যদি সরকারি বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হয় তাহলে ফের এই কাজে গতি বাড়াবে দলটি। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এখনো ৪২টি জেলা মেয়াদোত্তীর্ণ। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। ত্রিবার্ষিক এই সম্মেলনের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবং বড় কোনো দুর্যোগ দুর্বিপাক না থাকলে নির্ধারিত সময়েই জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এবং তার আগেই সারা দেশের মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলা কমিটিগুলোতে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আনতে চান তারা।

অন্যদিকে বর্তমানে যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতী লীগের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগেরও মেয়াদ শেষ। দীর্ঘদিন আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। মেয়াদ শেষের পরেই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত থাকলেও করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন এবং দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এই সংগঠনগুলোর সম্মেলনের আয়োজন করা হবে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রস্তুতি প্রসঙ্গে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ২০২২ সাল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের জন্য সাংগঠনিক বছর। এই বছরের মধ্যে পুনর্গঠন করা হবে সব মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি। এরপর কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী হিসাবে গড়ে তোলা হবে। তৃণমূলসহ দলে নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকলে তা নিরসন করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে। মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদের অপপ্রচারের জবাব দিতে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আওয়ামী লীগের গঠিত বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের সদস্যরা এ কাজ শুরু করবেন। বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা ও অপ্রচারের জবাব দেবেন তারা। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের সময়ে হওয়া বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরবেন তারা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতের সব অপপ্রচারকে প্রতিহত করতে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। তাদের সব গুজব আমাদের প্রতিহত করতে হবে। এর সঙ্গে তাদের ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে প্রতিহত করতে হবে। এজন্য আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা আগামী ২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করব। আমাদের নিজেদের মধ্যে সব মতবিরোধ দূর করতে হবে।

দলীয় প্রার্থী বাছাই : দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু না হলেও ভেতরে ভেতরে এই কাজও চলমান রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে একাধিক জরিপ পরিচালনা করে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের জরিপ চলমান আছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও প্রধানমন্ত্রীকে হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করে থাকে। এসব জরিপে জনপ্রিয়তায় কে এগিয়ে, তাদের অতীত ও বর্তমান এবং দুর্বল দিক-সবই থাকছে। আওয়ামী লীগের একাধিক বৈঠকে আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসন : অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের তৃণমূল। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ৭৩টি অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনায় নয়জন নিহত এবং ১০৪৪ জন আহত হয়েছে। সহযোগী সংগঠনগুলোর হিসাব ধরলে এই সংখ্যা আরও বেশি। দলটির নেতারা বলছেন, দলীয় সভাপতির নির্দেশে নির্বাচনের আগেই সব অভ্যন্তরীণ সমস্যা মিটিয়ে তৃণমূল পর্যন্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী করতে চান তারা।