

মো: সাইফুল্লাহ খাঁন, (সাংবাদিক ও কলামিস্ট) :
বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে একটি হলো প্রযুক্তি ও মিডিয়ার অভূতপূর্ব বিকাশ। এই দুটি মাধ্যম এখন মানুষের জীবনযাত্রার অঙ্গাঙ্গী অংশ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি মিডিয়ার বিস্তার আমাদের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। তবে এই অগ্রগতির পেছনে লুকিয়ে আছে কিছু গভীর সংকট, যা অবহেলা করলে সমাজ ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
সম্ভাবনার দিগন্ত:-
১. তথ্য প্রবাহে গতি ও পরিধি বৃদ্ধি :
প্রযুক্তির কল্যাণে তথ্যের প্রবাহ এখন অবাধ ও দ্রুত। এক সময়ে যেখানে একটি সংবাদ পৌঁছাতে দিন লেগে যেত, এখন সেখানে মুহূর্তেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গুগল, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তথ্যের সহজলভ্যতা মানুষকে সচেতন ও যুক্ত করেছে। এটি গণতন্ত্র চর্চা ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করছে।
২. শিক্ষা ও জ্ঞানের উন্মুক্ত জগৎ :
ই-লার্নিং, মোবাইল অ্যাপস, ডিজিটাল বই, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম—এসবের মাধ্যমে শিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স করতে পারছে। দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলেও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানসম্পন্ন শিক্ষা পৌঁছে যাচ্ছে। গণশিক্ষায় এটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন।
৩. সুবিন্যস্ত যোগাযোগ ও সংযোগ :
ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে প্রিয়জন, সহকর্মী, ব্যবসায়িক পার্টনারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। অনলাইন মিটিং, ভিডিও কল, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং ইত্যাদির মাধ্যমে আজ বিশ্বকে এক বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত করা সম্ভব হয়েছে।
৪. স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত :
টেলিমেডিসিন, হেলথ মনিটরিং অ্যাপস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-ভিত্তিক রোগ নির্ণয় প্রযুক্তি চিকিৎসাকে সহজ ও সুলভ করেছে। করোনা মহামারির সময় এই প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে।
৫. উদ্যোক্তা ও চাকরির সুযোগ :
ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদির মাধ্যমে লাখো তরুণ ঘরে বসেই আয় করছে। প্রযুক্তি অনেককে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিপদের কালো ছায়া:-
১. গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার ঝুঁকি:
প্রযুক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্যের আদান-প্রদানে গোপনীয়তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। হ্যাকিং, ফিশিং, ডেটা লিকের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত তথ্য শেয়ার করার ফলে অনেকেই অপরাধের শিকার হচ্ছেন।
২. মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি-নির্ভরতা :
সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক সময় মানুষকে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে। অন্যের ‘সুখী জীবন’ দেখে নিজের জীবনে হতাশা তৈরি হয়। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মমূল্যায়নের সংকট, বিষণ্নতা, একাকিত্ব ও আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্য :
মিডিয়ার একটি বড় সমস্যা হলো মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ ছড়ানো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, সামাজিক বিভ্রান্তি তৈরির জন্য কিংবা আর্থিক লাভের আশায় অনেকেই ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেয়। এই ফেক নিউজ কখনো কখনো জাতিগত সংঘাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও আইনি জটিলতার জন্ম দেয়।
৪. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় :
প্রযুক্তি মানুষের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করেছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রভাব ব্যক্তি সম্পর্কের উষ্ণতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার কথাবার্তা, একত্র সময় কাটানো দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দুর্বল হচ্ছে।
৫. প্রযুক্তি-নির্ভর অপরাধ ও আসক্তি
সাইবার বুলিং, পর্নোগ্রাফি, গেমিং অ্যাডিকশন, ডার্ক ওয়েবের মতো ভয়াবহ দিক প্রযুক্তির অন্ধকার দিক হিসেবে পরিচিত। কিশোর ও তরুণ সমাজ এই জালে জড়িয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত।
উপসংহার: মিডিয়া ও প্রযুক্তি একদিকে সম্ভাবনার দরজা খুলেছে, অন্যদিকে তৈরি করেছে কিছু জটিল বিপদ। তাই এই দুই শক্তিশালী মাধ্যমকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, শিক্ষার প্রসার, নৈতিকতার চর্চা ও আইনগত কাঠামোর উন্নয়ন। প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যক্তির দায়বদ্ধতা, পারিবারিক নজরদারি এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ একযোগে কাজ করলে এই সম্ভাবনাকে আশীর্বাদে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।
প্রযুক্তির যাত্রা থামবে না—তবে আমাদের প্রয়োজন এই যাত্রাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। সেই পথেই নিহিত রয়েছে একটি সুন্দর, নিরাপদ ও সচেতন সমাজ গঠনের ভবিষ্যৎ।