আজিজুল ইসলাম বারী,লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। তেমনই সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত মন্ডলপাড়া সিন্দুরিয়া জামে মসজিদ ও আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ী ইউনিয়নের গিলাবাড়ী গ্রামে অবস্থিত গিলাবাড়ী পুরাতন জামে মসজিদটি মোগল আমলে নির্মিত। এ মসজিদ দুটির গঠন পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশল ছিল শিল্পসমৃদ্ধ ও অনন্য।
কিন্তু অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে মসজিদ দুটি। ধ্বংসপ্রায় অবকাঠামো ছাড়া এর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
মসজিদ দুটি মোগল আমলের ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময় নির্মিত বলে জানা যায়।
মসজিদ সংরক্ষণের জন্য গত বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরে গিলাবাড়ী এলাকার স্থানীয় আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ নামের এক ব্যাক্তি আবেদন করেন।
ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে আবগান সুলতান দাউদ খাঁ করনারি মোগলদের কাছে চুড়ান্তভাবে পরাজিত হলে কার্যত বাংলায় মোগল শাসনের সুত্রপাত ঘটে। ১৫৭৯-১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসন কাঠামোয় বাংলা ‘‘সুবে বাঙ্গলা’’ নামে পরিচিতি পায়। মোগল-সম্রাট আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী টোডরমল ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘সুবে বাঙ্গলা’ কে ১৯টি সরকার এবং ৬৮৮টি মহালে বিভক্ত করেন। তন্মধ্যে সরকার ঘোড়াঘাট একটি। মোগল আমলে সরকার ঘোড়াঘাট থাকলেও বৃহত্তর রংপুরের উত্তরাঞ্চল মূলতঃ কুচবিহার রাজ্যর অধীনে ছিল। কুচবিহার মহারাজা নর নারায়ণের মৃত্যুর পর লক্ষ্মী নারায়ণ ও রঘুদেব নারায়ণের মাঝে বিবাদের সৃষ্টি হলে লক্ষ্মী
নারায়ণ মোগল শক্তির সাথে মিত্রতার বন্ধনকে অটুট করতে মোগল সুবাদার মানসিংহের সাথে স্বীয় ভগ্নী প্রভাদেবীর বিবাহ প্রদানের জন্য ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রস্তাব প্রেরণ করেন এবং সুবাদার মানসিংহ বর্তমান লালমনিরহাট জেলার উপর দিয়ে কুচবিহার গমণকালে এই এলাকায় ছাউনি স্থাপন করেন। ধারণা করা হয় মোগলরা এ সময় থেকেই এতদঞ্চলকে কুচবিহার বা কামরূপ অভিযানের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। মহারাজা লক্ষ্মী নারায়ণের মৃত্যুর পর মোগলদের সাথে কুচবিহারের সম্পর্কের অবনতি ঘটলে ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে মোগল বাহিনী পাঙ্গা আক্রমণ করে পাঙ্গা-রাজ মধুসূদনকে পরাজিত করলে তিনি মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন। ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার শায়েস্তা খান তদীয় পুত্র এবাদত খানের নেতৃত্বে কুচবিহারে অভিযান প্রেরণ করেন এবং তার নেতৃত্বে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে কাকিনা, কাযিরহাট ও ফতেহপুর চাকলা সরকার ঘোড়াঘাটের অধীনে আসে। এ সময় তিনি মোগলদের স্মরণে লালমনিরহাটে একটি হাট স্থাপন করেন, যা আজও মোগলহাট নামে পরিচিত।
সাপ্টিবাড়ি ইউনিয়নের সমাজসেবক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, প্রাচীন এই মসজিদটি সংরক্ষণ ও সংস্কার করা জরুরী প্রয়োজন। ভবিষ্যত প্রজন্মের দেশের ও ধর্মের ইতিহাস জানার জন্য সরকারের কাছে আমার দাবী এটি আগের আদলে রুপ দেয়ার।
পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সমাজসেবক রফিকুল ইসলাম মন্ডল বুলু বলেন, মন্ডলপাড়া সিন্দুরিয়া জামে মসজিদটি মোঘল আমলে নির্মিত। আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এই মসজিদের ইতিহাস জানতে পেরেছি। মসজিদটি সরকারি তালিকাভুক্ত করে সংরক্ষণ করলে পরবর্তী প্রজন্ম মোঘল আমলের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।
প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন প্রত্যেক জাতির অমূল্য সম্পদ। একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণে সাংবিধানিক তাগিদ থাকলেও বর্তমানে মসজিদ দুটি অপরিকল্পিত সংস্কারের মাধ্যমে এর ঐতিহাসিক গঠন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, সাপ্টিবাড়ী এলাকার গিলাবাড়ী মসজিদটির মূল কাঠামো ভেঙ্গে ফেলারও চেষ্টা চালাচ্ছেন একটি মহল ।
জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, ঐতিহাসিক ও প্রাচীন নিদর্শনসমূহ প্রত্নতাত্বিক অধিদপ্তর থেকে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত এ জেলায় দুটো প্রাচীন মসজিদের সন্ধান মিলেছে। একটি পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে ও আরেকটি সাপ্টিবাড়ি ইউনিয়নে গিলাবাড়ী এলাকায় অবস্থিত। মসজিদ দুটির স্মৃতি সংরক্ষনের জন্য প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করবে। ঐতিহাসিক ও প্রচীন নিদর্শনসমূহ কোনোভাবে যেনো ধ্বংস না হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।